Advertisement
E-Paper

কাঁপছে ঘর, ক্রমে বাড়ছে ফাটল! বৌবাজারের দুর্গাপিতুরি লেন ত্রস্ত ধর্মতলা-শিয়ালদহ মেট্রোয়, কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না

বৌবাজারের দুর্গাপিতুরি লেনের বাড়ির দেওয়ালে প্রথম ফাটল দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে। ছ’বছর কেটে গিয়েছে। পাতালপথে জুড়ে গিয়েছে ধর্মতলা আর শিয়ালদহ। কিন্তু দুর্গাপিতুরি লেন এখনও সেই তিমিরেই।

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১১:১৯
বৌবাজারের দুর্গাপিতুরি লেনের বাড়িতে বাড়িতে ফাটল। সংস্কারের কাজ চলছে।

বৌবাজারের দুর্গাপিতুরি লেনের বাড়িতে বাড়িতে ফাটল। সংস্কারের কাজ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাঁ দিকে রান্নাঘর। দরজার পাশে রাখা কালো বালতিটা শুরুতেই খানিক বিসদৃশ ঠেকল। ঠাহর করে বোঝা গেল, রান্নাঘরের ছাদের একাংশ থেকে অনবরত ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে সেই বালতিতে। সে দিক থেকে জিনিসপত্র সব সরিয়ে দিতে হয়েছে। শুধু রান্নাঘর নয়, ১৯ নম্বর দুর্গাপিতুরি লেনের সিঁড়ি থেকে শুরু করে শৌচালয়, শোয়ার ঘর— সর্বত্র ফাটল। কোথাও দেওয়াল চুঁইয়ে জল পড়ছে, কোথাও হেলে গিয়েছে বারান্দার একাংশ।

কলকাতা মেট্রোর দৌলতে পাতালপথে জুড়ে গিয়েছে ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ। কিন্তু দুর্গাপিতুরি লেন আছে সেই তিমিরেই। প্রতি দিন ভূগর্ভস্থ পথে মেট্রো ছুটছে আর রাস্তার উপরের বাড়িঘর কাঁপছে থরথর করে। নিরুপায় বাসিন্দারা সেখানেই কোনও রকমে মাথা গুঁজে আছেন। নতুন পথের মেট্রোয় সফর করেছেন? প্রশ্ন শুনে পাল্টা ধমক দিলেন অর্চনা চৌধুরী, ‘‘মেট্রোর জন্যেই তো আমাদের বাড়িঘরের এই অবস্থা। ওদের কাজ তো দেখলাম। মেট্রো চাপব কোন ভরসায়? হয়তো চলন্ত মেট্রোতেই বাড়ি ভেঙে পড়বে।’’

বিতর্কের সূত্রপাত বছর ছয়েক আগে। বৌবাজারের দুর্গাপিতুরি লেনের বা়ড়ির দেওয়ালে প্রথম ফাটল দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে। মেট্রোর কাজের জন্য ঘরছাড়া হতে হয়েছিল বাসিন্দাদের। প্রথমে কিছু দিন হোটেলে ছিলেন। ২০২২ সালের পর বছর দুয়েক অন্যত্র কেটেছে। এখন কেউ কেউ ফিরেছেন। ভিটে ফিরে পাবেন কি না, সে ব্যাপারে এখনও অনেকে অনিশ্চিত। তা হলে উপায়? পিতৃপুরুষের ভিটে বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও বাড়ি করবেন? সে পথও বন্ধ। বিপজ্জনক এই রাস্তার উপর জমি-বাড়ি কে কিনবে? কোনও প্রোমোটারও ঝুঁকি নিতে চাইবেন না, দাবি ভুক্তভোগীদের। আর তাই ফাটল, কম্পন আর ছাদ চুঁইয়ে পড়া জলের মতো কিছু ‘অভিশাপ’ এখন দুর্গাপিতুরি লেনের নিত্যসঙ্গী। মসৃণ পাতালপথের উপরে এক অমসৃণ জীবন।

দুর্গাপিতুরি লেনের বাড়ি ভেঙে সংস্কারের কাজ চলছে।

দুর্গাপিতুরি লেনের বাড়ি ভেঙে সংস্কারের কাজ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।

যত্রতত্র ফাটল

অধিকাংশ বাড়ির দেওয়ালেই ফাটল। কোথাও মেঝে, সিঁড়ি, এমনকি সিলিংও ফেটে গিয়েছে। ক্রমশ সে সব ফাটল বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি মেরামত করে দিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। তবে বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘দায়সারা’ কাজ হয়েছে। তাই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সাহায্য চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি বাসিন্দাদের একাংশের। কারও কারও অভিযোগ, অদক্ষ রাজমিস্ত্রিদের বাড়ি মেরামতের কাজে নিয়োগ করেছে মেট্রো। ১/৪, দুর্গাপিতুরি লেনে মোট ১২টি পরিবারের বাস। সেখানকার ফাল্গুনী সিংহ ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন, মেঝে ফেটে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৯ সালে প্রথম বারের ফাটল আমরা নিজেরাই সারিয়ে নিয়েছিলাম। ২০২২ সালে তো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হল। দু’বছর পর ফিরে দেখলাম, জোড়াতালি দিয়ে ফাটল সারিয়ে দিয়ে গিয়েছে।’’

মেট্রো চললেই ‘ভূমিকম্প’

দুর্গাপিতুরি লেন লাগোয়া বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ছোট্ট দোকান পরিতোষ করের। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ রুটে মেট্রো চালু হওয়ার পর থেকে অষ্টপ্রহর সেই দোকান কাঁপছে। মনে হচ্ছে, সারা ক্ষণ ভূমিকম্প হচ্ছে। আতঙ্কে ঘুম উড়েছে পরিতোষদের। বললেন, ‘‘প্রতি বার মেট্রো যাচ্ছে আর আমাদের ঘরটা থরথর করে কাঁপছে। রাতের দিকে প্রচণ্ড আওয়াজ হচ্ছে। মেট্রো কর্তৃপক্ষকে বললেও তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কী হবে জানি না।’’ মেট্রোর ‘ট্রায়াল রান’-এর সময়েই বিপদ বুঝেছিলেন পরিতোষ। মাটির নীচ দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় কাঁপুনির চোটে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, এই কম্পন বন্ধ হওয়া দরকার। পরিতোষের কথায়, ‘‘ওঁরা তখন ইঞ্জিনিয়ারদের পাঠিয়েছিলেন। তিন দিন তাঁরা এখানে বসে সব দেখে গিয়েছেন। আমাদের বললেন, আর কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু কোথায় কী! মেট্রো চালু হওয়ার পর আবার সেই আওয়াজ, আবার কম্পন। লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়ে এসেছি।’’ ক্ষোভ উগরে দিলেন ৬এ, দুর্গাপিতুরি লেনের বাসিন্দা বৃদ্ধা সন্ধ্যা দত্ত, ‘‘আমি বাড়িতে একা থাকি। নীচ দিয়ে মেট্রো যায়। বাড়িটা কাঁপে। খুব ভয় করে। কত বাড়ি তো চোখের সামনে পড়ে গেল। দু’বছর বাইরে ছিলাম। এই বাড়িও যদি ভেঙে পড়ে?’’ এখনও নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেননি গৌতম লাহা। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও দাঁত যদি রোজ নড়ে, তবে এক দিন না এক দিন তো পড়ে যাবেই! এখানকার বাড়িগুলোরও সেই অবস্থা।’’

পরিতোষ কর। এঁর দোকানের নীচ দিয়ে গিয়েছে মেট্রো। নানা সমস্যার মুখে পড়েছেন।

পরিতোষ কর। এঁর দোকানের নীচ দিয়ে গিয়েছে মেট্রো। নানা সমস্যার মুখে পড়েছেন। নিজস্ব চিত্র।

ছাদ চুঁইয়ে জল

ভরা বর্ষায় দুর্গাপিতুরি লেনের প্রায় অনেক বাড়ির ছাদ থেকেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে। দেওয়াল থেকেও জল গড়াচ্ছে। বাসিন্দাদের দাবি, ২০২২ সালের আগে এই সমস্যা ছিল না। মেট্রো আধিকারিকেরা ছাদে নতুন ছাউনি বসিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। জল আটকাতে বসানো হয়েছে পিচের আস্তরণও। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। সেই আস্তরণ কোথাও ফেটে গিয়েছে, কোথাও ফেঁপেফুলে উঠেছে। এমনকি, উপরে দোতলা থাকলেও একতলার ঘরের ছাদ থেকে জল পড়ছে। দোকানদার পরিতোষ বললেন, ‘‘এত জল পড়ে যে, বালতি পেতে রাখতে হয়। আমরা বালতি বালতি জল শুধু ফেলে আসছি আর তারপরে আবার বালতি বসাচ্ছি। দোকানের উপরের তলা এক থেকে দেড় ফুট বসে গিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারেরাও তেমনই জানিয়েছেন। কিন্তু এখনও সারানো হয়নি। মেট্রোর কারণেই আমাদের এই যন্ত্রণা।’’ রান্নাঘরের বালতির পাশের জল মুছে এগিয়ে এলেন অনীতা সাউ। গলায় প্রতিবাদী সুর, ‘‘মেট্রোর লোকেরা বলেছেন, টিন লাগিয়ে দেবেন। বর্ষা কাটলে ছা়দ সারাবেন। কিন্তু আমাদের দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা বাড়ি মেরামতের জন্য খরচ হয়ে গিয়েছে। ২০২২ সালের পর থেকেই এ সব বেশি হচ্ছে।’’ পাশ থেকে অনীতার শাশুড়ি ছবি সাউয়ের প্রশ্ন, ‘‘এখন তো ওঁরা করে দেবেন বলছেন, কিন্তু ওঁরা চলে গেলে কী হবে?’’

হেলে গিয়েছে বাড়ি

২০২২ সালের দুঃস্বপ্ন এখনও ভুলতে পারেন না অনীতারা। মেট্রোর নির্মাণের কারণে তাঁদের ঘরের একাংশ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল। দোতলার শোয়ার ঘর থেকে একতলা দেখা যাচ্ছিল। পুলিশের ‘মাইকিং’ শুনে কোনও রকমে টুকটাক জিনিস সঙ্গে নিয়ে বা়ড়ি ছেড়েছিলেন। এখন ফিরেছেন। কিন্তু বাড়ি এক দিকে হেলে রয়েছে। বারান্দা, সিঁড়ির একাংশ যে ঢালু, তা খালি চোখেও স্পষ্ট বোঝা যায়। অনীতা বলছিলেন, ‘‘বাড়িটার পিছন দিক বেঁকে গিয়েছে। এত বাড়ি ভেঙে পড়তে দেখেছি! খুব ভয় করে।’’

ভেঙে পড়ছে চাঙড়

সোমনাথ ভারতীদের বা়ড়িতে আবার অন্য সমস্যা। কিছু দিন আগে তাঁদের ঘরের একাংশের ছাদের চাঙড় ভেঙে পড়েছে। সোমনাথের অসুস্থ মা সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছিলেন। তাঁর কাঁধে চাঙড়ের টুকরো পড়ে। অভিযোগ, মেট্রো কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে কোনও সাহায্য করতেই চাননি! কোনও রকমে ঘরের ওই অংশ নিজেই সারিয়ে নিয়েছেন সোমনাথ। তাঁর কথায়, ‘‘মেট্রোর লোক এসে দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু বললেন, এখানে ওঁরা হাত দেবেন না। বাড়ি পুরনো, তাই ভেঙে পড়েছে। ঘর সারাতে আমাদের ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। মেট্রোর কারণেই তো বাড়ির এই অবস্থা।’’

সোমনাথ ভারতীর মা। সপ্তাহ তিনেক আগে এঁর কাঁধেই চাঙড় ভেঙে পড়েছিল।

সোমনাথ ভারতীর মা। সপ্তাহ তিনেক আগে এঁর কাঁধেই চাঙড় ভেঙে পড়েছিল। নিজস্ব চিত্র।

এক দিকে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, এক দিকে হিদারাম ব্যানার্জি লেন। মাঝে জলকাদায় ভরা দুর্গাপিতুরি লেনকে এক পরিত্যক্ত পথের মতো লাগে। সারা ক্ষণ কিছু না কিছু নির্মাণের কাজ চলছে। একটা গাড়িও ঠিক করে ঢোকানো যায় না। রাতে এই রাস্তা হয়ে ওঠে মদ্যপদের আখড়া। এলাকার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ মোতিলাল বললেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের দুর্গাপিতুরি লেন একটা নো ম্যান্‌স ল্যান্ড হয়ে পড়়ে আছে। কেউ ফিরেও তাকায় না। সারা ক্ষণ কাজ চলছে। প্যাচপেচে কাদা। এই রাস্তাই আমাদের সমস্যার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।’’ যদিও অনেকে বলছেন, বাড়িঘর সংস্কারের কাজ চলছে বলেই রাস্তার কাজ স্থগিত রয়েছে।

দুর্গাপিতুরি লেন এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় মোট ১৭০টি বাড়ি। তার মধ্যে ১৭ থেকে ১৮টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা ঘরছাড়া। ৪০০-রও বেশি মানুষ গত কয়েক বছর ধরে এই দুর্ভোগের শিকার। পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল বটে। কিন্তু বাসিন্দাদের অভিযোগ, সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি বিচার করে কোনও অর্থসাহায্য করা হয়নি এখনও। ‘বৌবাজার মাটি ও মানবকল্যাণ সোসাইটি’র সদস্য সঞ্জয় সেন বলেন, ‘‘লক্ষ লক্ষ মানুষ মেট্রোয় যাতায়াত করছেন। তাঁরা খুশি। কিন্তু আমাদের বুকের উপর দিয়ে মেট্রো চলছে। এই মেট্রোর কারণে আমাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই। আমরা কী করে এই মেট্রোয় চড়ব?’’ কর্তৃপক্ষের উপর বিশ্বাস হারিয়েছেন সঞ্জয়রা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমে বলা হয়েছিল দু’বছর। সেখান থেকে চার হয়ে ছ’বছর হয়ে গেল। ওঁরা ভাবছেন, আমাদের কিছু যায়-আসে না। ওঁদের কোনও কথায় আর বিশ্বাস হয় না। যখন দেখব বাড়ি তোলার জন্য ইট পড়েছে, একমাত্র তখনই বিশ্বাস করব!’’

Kolkata Metro Kolkata East West Metro
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy