আজ, ৯ সেপ্টেম্বর। সেই দিন। ঠিক এক মাস আগে এ দিন সকাল থেকে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য। আর জি করের সেমিনার কক্ষ থেকে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার দেহ উদ্ধারের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল সকলকে। কী ভাবে কর্তব্যরত এক চিকিৎসক তাঁর কর্মস্থলে খুন-ধর্ষণের শিকার হতে পারেন সেই প্রশ্ন, আর বিচারের দাবির আগুন, এখন রাজ্য ছাড়িয়ে দেশ জুড়ে জ্বলছে। আঁচ ছড়িয়েছে বিদেশেও।
দেহ উদ্ধারের দিন রাতেই এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। কিন্তু সে একা জড়িত, তা মানতে চায়নি চিকিৎসক মহল। শুরু হয় আন্দোলন। দাবি ওঠে, আর জি করের অধ্যক্ষ-সহ বাকি পদাধিকারীদের বরখাস্ত বা পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু তাতে গড়িমসির অভিযোগ ওঠে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের চাপে অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ পদত্যাগ করলেও সরকার যে তা গ্রহণ করবে না, সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। উল্টে তিনি সন্দীপকে অন্যত্র বদলির কথা নিজেই ঘোষণা করেন। সেই মতো ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সন্দীপকে বদলির নির্দেশিকা বার হতেই, আন্দোলনের আগুনে ঘি পড়ে।
অন্য দিকে, পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে তত দিনে বিভিন্ন অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। তরুণী চিকিৎসকের দেহ মিলেছিল যে সেমিনার কক্ষে, সেটির সংলগ্ন জায়গায় ভাঙাচোরার কাজ-সহ বিভিন্ন বিষয়ে সরব হন চিকিৎসকেরা। দেহ উদ্ধারের পাঁচ দিনের মাথায়, অর্থাৎ ১৩ অগস্ট তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। লম্বা ছুটিতে পাঠানো হয় সন্দীপকে। তত দিনে অবশ্য জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের আঁচ বহু দূর ছড়িয়েছে। তাতে শামিল হন সিনিয়র চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে আর জি করে বহিরাগতদের তাণ্ডব বড়সড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় কলকাতা পুলিশকে।
তাঁদের কর্মসূচিতে প্রথম থেকেই রাজনীতির কোনও রং লাগতে দিতে নারাজ ছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। তাই, আন্দোলনকে জোরদার করতে রাজ্যের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গীদের নিয়ে তাঁরা গঠন করেন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট’। সমস্ত দোষীকে চিহ্নিত করে ন্যায্য বিচার, কলকাতার নগরপালের পদত্যাগ, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উপযুক্ত সুরক্ষা পরিকাঠামো গড়ে তোলা-সহ কয়েকটি দাবিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন-কর্মবিরতি আজও অব্যাহত। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট, মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন (কাজে যোগ দেওয়ার) কোনও কাজে আসেনি। উল্টে লালবাজার অভিযান করে, তাতে বাধা পেয়ে প্রায় ২২ ঘণ্টা দাঁতে দাঁত চেপে শহরের পথে বসে থেকেছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। পরে অবশ্য তাঁদের দাবি মেনে মিছিল যায়। এবং নগরপালের সঙ্গে দেখা করে তাঁর পদত্যাগের স্মারকলিপি জমা দিয়ে আসেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। নগরপালের টেবিলে রেখে আসেন প্রতীকী শিরদাঁড়া!
এ সবের মধ্যেই দুর্নীতি মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন সন্দীপ। তাঁকে সাসপেন্ড করে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু খুন-ধর্ষণের মামলায় তদন্তের গতিপ্রকৃতি কত দূর? সেই প্রশ্নেই জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলছে। তার জেরে সরকারি হাসপাতালে রোগী ভোগান্তির অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে প্রথম থেকেই। যদিও সাধারণ মানুষ এখনও ডাক্তারদের পাশে রয়েছেন। মেনে নিচ্ছেন জুনিয়রদের কাজ বন্ধ রাখাকে। সিনিয়র শিক্ষক চিকিৎসকেরা ছুটি বাতিল করে পরিষেবা সামলাচ্ছেন বলে দাবি করেছে স্বাস্থ্য ভবন। কিন্তু শুক্রবার কোন্নগরের দুর্ঘটনাগ্রস্ত যুবকের মৃত্যু, আর জি করকে ‘কাঠগড়ায়’ দাঁড় করিয়েছে। যদিও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ মানতে নারাজ ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে সেখানকার আন্দোলনরত আবাসিক চিকিৎসকেরা।দাবি, মানুষের পাশে থাকতে ইতিমধ্যেই আর জি কর থেকে তাঁরা চালু করেছেন ‘অভয়া ক্লিনিক’। প্রতিদিন সেখানে টেলিমেডিসিন পরিষেবা চলছে। প্রতি রবিবার বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে স্বাস্থ্য শিবির। রাজ্য জুড়ে এ দিন ৩০টি শিবির চলেছে। শহরে শিবিরের সঙ্গেই হয়েছিল ‘জনতার মতামত, রাজপথে আদালত’। সেখানে মানুষ দাবি তুললেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দোষীদের কঠিনতম শাস্তির। সেই দাবিতে ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমেছে চিকিৎসক সংগঠন, রাজনৈতিক শিবির। চলছে সমাবেশ-মিছিল, রাত দখলের কর্মসূচি।
কিন্তু যে কোনও রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চান জুনিয়র চিকিৎসকেরা। আজ সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে চোখ রাখার আগে জেগে থাকল আর জি কর। আন্দোলনকারীদের তরফে অনিকেত মাহাতো, কিঞ্জল নন্দ, সৌম্যদীপ রায়েরা দাবি তুললেন, ‘জারি থাকুক, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।