Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
PARSIAN

আজ তাঁদের নববর্ষ, কলকাতার পার্সিরা মেতেছেন উৎসবে

প্রতি বছর ২১ মার্চ ইরানিয়ায় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পারসিরা তাঁদের নতুন বছরকে স্বাগত জানান। একে বলে নওরোজ। উৎসবের বেশ কিছু দিন আগে থেকে জোরকদমে তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

কলকাতার পার্সি ধর্মশালা। ছবি: লেখক।

কলকাতার পার্সি ধর্মশালা। ছবি: লেখক।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ১৫:৫৮
Share: Save:

কাজ করতে করতে গুনগুন করে গান গাইছিলেন সানোবর মেহেরজি। বউবাজারে বৃটিশ আমলের বাড়ি। এই বাড়িতেই বসবাস মেহেরজি পরিবারের। সানুবরের স্বামী সাইরাস মেহেরজির বাবা অল্পবয়সে মুম্বই থেকে কলকাতায় চলে আসেন। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। সেই সময় বউবাজার, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এলাকায় বহু পার্সি পরিবার থাকত। বিশাল বিশাল বাড়িগুলির এক একটা তলা নিয়ে নিজেদের মতো করে মেতে থাকতেন তাঁরা। আড্ডা, নাটক, গান, গল্প, নাচ, সিনেমা, খেলা সব নিয়ে কলকাতার মধ্যে মিশে গিয়েও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে নিজস্ব পরিমণ্ডল গেড়ে তুলেছিলেন পার্সিরা। তাই খুরশেদজি মেহেরজির এই জায়গাটাই সব থেকে পছন্দ হয়ে যায়। অপিরিচিত শহর আস্তে আস্তে আপন হয়ে ওঠে। আরও বহু পার্সি পরিবারের মতো তিনিও এমন বাঁধা পড়েছিলেন এই শহরের মায়ায় যে আর যেতে পারেননি কলকাতা ছেড়ে।

ঘরের কোণে ছোট কুলুঙ্গিতে জরাথ্রুস্টের ছবির সামনে জ্বলছে অনির্বাণ প্রদীপশিখা। পারসিরা অগ্নি উপাসক। পবিত্র এই আগুন সারা দিন রাত জ্বালিয়ে রাখেন তাঁরা। নিভতে দেন না কখনও। তার পাশেই দেওয়ালে ঝুলছে ‘আসো ফরোহর’। জরাথ্রুস্টবাদীদের প্রতীক। পুরো ঘরটাতে সুস্পষ্ট পার্সি ছাপের সঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছে বাঙালিআনা। কাজ করতে করতেই সানোবর বললেন, ‘‘আমার নামের মানে জানেন? সাইপ্রাস গাছ। আমাদের ইরানে হয়। দেখার মতো সুন্দর।’’

ইরান পার্সিদের আদিভূমি। মধ্যযুগে মুসলমান আক্রমণে বিধ্বস্ত ইরান ছেড়ে একসময় দলে দলে মানুষ গ্রিস, রোম, চিন, ভারত-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় চলে আসতে থাকেন। এঁরা পারস্যের বাসিন্দা ছিলেন বলে এদের পার্সি বলা হয়। নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচাতে ইরান ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও অন্তরে প্রতিনিয়ত ছেড়ে আসা দেশকে বহন করেন পার্সিরা। জন্মভূমি ছেড়ে পার্সিদের যে অংশটি ভারতে চলে এসেছিল তারা এসে পৌঁছয় গুজরাতে সানজান বন্দরে। গুজরাতের রাজা তাঁদের আশ্রয় দেন।

আরও পড়ুন: রঙাচ্ছন্ন উন্মাদনায় উদ্‌যাপন শুরু দোলের দু’দিন আগেই

নওরোজের খাওয়াদাওয়া।

এর পর মুম্বই, পুনে উটি সমেত দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন তাঁরা। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে দাদাভাই বেহরামজি বানাজি নামে এক পারসি ব্যবসায়ী প্রথম কলকাতায় আসেন। সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় নিজেদের শক্তি সংহত করছে। পূর্ব এশিয়া, ভারত আর ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন তখন জোরকদমে। এই অবস্থায় নিজের স্বাভাবিক ব্যবসায়িক বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা আর আফিমের মতো ব্যবসাগুলিতে নিজেদের জায়গা করে নেন পার্সিরা। এর পর মেরওয়ানজি তবকব নামে এক ব্যবসায়ী কলকাতায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। প্রথম দিকের পার্সি ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য নাম সম্ভবত রুস্তমজি কওয়াসজি বানাজি। টার্নার নামে এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর সঙ্গে রুস্তমজি টার্নার অ্যান্ড কোং নামে একটি বিজনেস ফার্ম খোলেন তিনি। কিছু দিনের মধ্যেই ৬ লক্ষ টাকা দিয়ে খিদিরপুর বন্দর কিনে ফেলেন। সেই সঙ্গে কেনেন ২৭টি জাহাজ যেগুলি তিনি ব্রিটিশ সরকারকে লিজ দিয়ে দেন। ‘রুস্তমজিবাবু’ দানও করতেন দুই হাতে। গরিবদের জন্য পাকা বাড়ি থেকে চ্যারিটেবল হসপিটাল তৈরি, রাস্তা থেকে খাল সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজে অর্থব্যয় করেছেন তিনি।

এর পর বহু দিন কেটে গিয়েছে। পারসিরা কলকাতার শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছেন ওতপ্রোত ভাবে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভাবে কমতে থেকেছে তাঁদের সংখ্যা। শুধু এ শহর বা এ দেশ নয়। জরাথ্রুস্টের উপাসকরা সারা পৃথিবী জুড়েই এখন সংখ্যালঘু। কলকাতাতে বছর চল্লিশ আগেও প্রায় আড়াই হাজার পারসি ছিলেন। এখন সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৫০ জনে। বউবাজার ধর্মতলা এলাকার স্কুলগুলি এক সময় ভর্তি থাকত পার্সি ছাত্রছাত্রীতে। পার্সিদের ক্রিকেট ক্লাব, টেনিস ক্লাব আগে জমজমাট ছিল। প্রতি ছুটির দিন জমিয়ে চলত লিগের খেলা। কলকাতা পার্সি ইয়ুথ লিগ, কলকাতা পার্সি ক্লাবে নানা অনুষ্ঠান হত বছরভর। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের বয়েজ আর গার্লস স্কাউট হত পার্সি ধর্মশালায়।

এখন শুধুই সব হারানোর সময়। কোনও কিছুই আর নেই আগের মতো। ১৯০৯ সালে রুস্তমজির স্মৃতিতে তাঁর মুম্বই এবং চিনের পারসি বন্ধু এবং অনুগামীরা ধর্মশালাটি তৈরি করেন বো স্ট্রিটে। বিরাট অতিথিশালা তখন গমগম করত সারা দিন। চিন, ইরান, মুম্বই, গুজরাত থেকে সারা বছর চলত অতিথিদের আনাগোনা। এখন খাঁ খাঁ করে অতিথিশালা। না আছে অতিথি, না আছে আগের জৌলুস। ধর্মশালাটি চালান দারা হানসোতিয়া আর তাঁর স্ত্রী মেহের। গুজরাত থেকে বছর পাঁচেক আগে এখানে এসেছেন তাঁরা। চমৎকার পারসি খাবার বানান হানসোতিয়া দম্পতি। আক্ষেপ করে বলছিলেন, কলকাতা থেকে পারসিরা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে প্রতি মুহূর্তে বোঝা যায় সেটা। এমন একটা শহর থেকে হারিয়ে যেতে ভাল লাগে না। তবে আক্ষেপ আর কষ্ট যতই থাক তাতে পারসিদের প্রাণপ্রাচুর্যে ভাঁটা পড়েনি একটুও।

আরও পড়ুন: বাড়ির দেওয়াল লিখতে দেবেন কে, মা না মেয়ে?

পার্সিদের নওরোজের টেবিল।

প্রতি বছর ২১ মার্চ ইরানিয়ায় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পারসিরা তাঁদের নতুন বছরকে স্বাগত জানান। একে বলে নওরোজ। উৎসবের বেশ কিছু দিন আগে থেকে জোরকদমে তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ঘরদোর পরিষ্কার করে সুন্দর ভাবে সাজানো হয়। নতুন রংয়ের পোঁচ পড়ে বাড়িগুলিতে। কেনা হয় ঘর সাজানোর নানা উপকরণ। নতুন জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া আর উপহারের প্যাকেটে ভরে যায় বাড়ি। উৎসবের দিন সকাল থেকে শুরু হয় ‘জশন’। ভোরে উঠে বাড়িতে প্রার্থনা সেরে প্রদীপ জ্বালিয়ে পারসি ফায়ার টেম্পলে পুজো দিতে যান। মেটকাফ স্ট্রিটে ১৯১২ সালে আনজুমান আতশ আদরান বা ফায়ার টেম্পলটি তৈরি করেন ধুনজিভয় বৈরামজি মেটা। ১৮৪৯-এ তৈরি শহরের প্রথম পারসি ফায়ার টেম্পলটি এখন পরিত্যক্ত। ফায়ার টেম্পলের ওপরের তলায় বিরাট এক আধার ‘আফারগানু’তে সারা দিন আগুন জ্বলে। বলা হয়, যোদ্ধা, কৃষক, বণিক আর পুরোহিতদের কাছ থেকে আগুন নিয়ে ফায়ার টেম্পলগুলির অখণ্ড আগুন জ্বালানো হয়। জশনের সময় চার জন পুরোহিত উপস্থিত থাকেন মন্দিরে। প্রার্থনার শেষে পারসিরা ছোট ছোট চন্দনকাঠের টুকরো আগুনে আহুতি দেন। পুজোর পর উপস্থিতদের হাতে ‘চাসনি’ দেন পুরোহিতরা। এতে থাকে মিষ্টি রুটি আর ফল। সন্ধ্যাবেলা উপহার নিয়ে পরস্পরের বাড়ি যান পারসিরা। রাতের বেলা পারসি ক্লাবে নাচগানের অনুষ্ঠান হয়।

নওরোজের দিন শুভ সময় দেখে বাড়িতে টেবিল সাজান এঁরা। টেবিল সাজানো নওরোজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই টেবিলে দেওয়া হয় গম, বার্লি, অথবা অঙ্কুরিত ডাল, যা পুনর্জন্মের ইঙ্গিত বহন করে, গমের পুডিং বা ‘সামানু’ যা সমৃদ্ধির প্রতীক, ‘সেনজেদ’ বা বন্য জলপাই গাছের শুকনো ফল যা প্রেমের প্রতীক, ঔষধির প্রতীক রসুনের কোয়া, স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্যের প্রতীক আপেল। টেবিলে কাচের পাত্রে রাখা হয় গোল্ডফিশ, আয়না, গোলাপজল। এই দিন নানা রকম রান্নাও হয় বাড়িতে। পারসিরা মাছকে শুভ মনে করেন। প্রায় সব শুভ দিনে অন্যান্য রান্নার সঙ্গে বানানো হয় মরি ডাল, ফিশ বা প্রন প্যাটি। অড়হর ডাল, রসুন, পেঁয়াজ, টম্যাটো, জিরেবাটা দিয়ে তৈরি হয় মরি ডাল আর কাঁচা লঙ্কা, রসুন, ভিনিগার টম্যাটো পিউরি দিয়ে তৈরি হয় ফিশ প্যাটি। মনভোলানো স্বাদ গন্ধের এই দুই ট্র্যাডিশনাল রান্না ছাড়াও করা হয় পাতরানি ফিশ, আলেটি পালেটি, চিকেন পোলাও, ডাল, সালি চিকেন, পারসি অমলেট আরও নানা পদ। এ দেশে চলে আসার পর অগস্ট মাসে পার্সি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আরও এক বার নতুন বছরের উৎসব পালন করেন তাঁরা। একে বলে জামশেদ-ই-নওরোজ। এই দিন অন্যান্য উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে ‘নাটক’ করেন তাঁরা। স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে নাটকের রিহার্সাল দেওয়া, হইহই করে চলে প্রস্তুতি। কখনও কখনও মুম্বই বা সুরাত থেকে আসে পেশাদার পার্সি নাটকের দল।

পার্সি ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলে তাঁদের ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। এই অনুষ্ঠানকে বলে নভজ্যোত। এর পর থেকে এই ধর্মের প্রতীক ‘কুস্তি’ আর ‘সদরা’ পরার অনুমতি পান তাঁরা। এই দিন ঘরে বিরাট বড় থালায় চাল রাখা হয় পুরোহিতকে দেওয়ার জন্য। ঘর সাজানো হয় সুন্দর ফুলে। অতিথিদের এই ফুল উপহার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের পর তার ভবিষ্যৎ জীবনের সমৃদ্ধির জন্য বাচ্চাটির মাথায় দেওয়া হয় আমন্ড, বেদানা আর নারকেলের টুকরো। এমনিতে উদারহৃদয় আর খোলামেলা মনের হলেও সম্প্রদায়ের রীতিনীতির ব্যাপারে রক্ষণশীল পার্সিরা। সম্প্রদায়ের বাইরে ছেলেমেয়েদের বিয়ে সাধারণত অনুমোদন করেন না তাঁরা।

আরও পড়ুন: ‘তোজোর জন্যই লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে’

পার্সি ফায়াল টেম্পল।

পার্সিরা পৃথিবী, আগুন, জল-সহ প্রকৃতির পাঁচটি উপাদানকে পবিত্র বলে মনে করেন। সেই জন্য মৃত্যুর পর তাঁরা দেহ পোড়ান না বা সমাধি দেন না। এঁদের মৃত্যু-পরবর্তী আচার-আচরণগুলি তাই অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মৃত্যুর পর স্নান করিয়ে, শ্বেত বস্ত্র পরিয়ে শববাহকরা দেহকে নিয়ে যান পার্সি টাওয়ার অব সাইলেন্সে। এই চার জন বাহক ছাড়া টাওয়ার অব সাইলেন্সে ঢোকার অনুমতি নেই কারও। এখানে গোলাকার একটা জায়গায় দেহ নামিয়ে রাখেন শববাহকেরা।

আজ, বৃহস্পতিবার নওরোজ। বাকি পার্সিদের মতো সানোবর, মেহেরদেরও এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। এই নওরোজে অনেক দিন পর কিছু পার্সি পরিবারের কলকাতায় আসার কথা, ধর্মশালায় উঠবেন তাঁরা। সেখান থেকেই যাবেন পার্সি ফায়ার টেম্পলে। ইরানে মুসলিম আর ইরানি জরাথ্রুস্টিয়ানদের মধ্যে নিয়ত সংঘাত চললেও কলকাতার ফায়ার টেম্পল দেখাশোনা করেন মুসলিমরাই। মুসলমান আর পার্সিদের খাদ্যাভ্যাস অনেকাংশে এক বলে, মন্দিরের রান্নাবান্নাও রয়েছে মুসলমানদেরই দায়িত্বে।

জুড়ে রাখতে সত্যিই এই শহরটার জুড়ি মেলা ভার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE