ছাই: পুড়ে যাওয়া ঘরে নমুনা সংগ্রহ করছে ফরেন্সিক দল। শনিবার।
একটি আবাসনের তিনতলার বারান্দায় তারস্বরে চিৎকার করছে ১৪ মাসের কুকুর রসি। গ্রিলের ফাঁক গলে কার্যত নীচে ঝাঁপ দিতে চাইছে সে। অস্বাভাবিক ওই চিৎকারে সন্দেহ হয় এলাকাবাসীর। ওই আবাসনের নীচ থেকেই হঠাৎ তাঁরা লক্ষ করেন, পাশের জানলা থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তখন তাঁরা আবাসনের তিনতলায় উঠে ঘরের দরজা ভাঙতেই আগুনের হল্কা বেরিয়ে আসে। দেখা যায়, ঘরের ভিতরে সোফার উপরে হাত-মুখ এবং শরীরের বাকি অংশ উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়া অবস্থায় দাউদাউ করে জ্বলছেন এক বৃদ্ধা।
পুলিশ জানায়, শনিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে পঞ্চসায়র থানা এলাকার নয়াবাদের এক আবাসনে। পুলিশ ও দমকলের কর্মীরা ওই বৃদ্ধাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। দেখা যায়, তাঁর মুখ ও শরীরের অধিকাংশই পুড়ে গিয়েছে। চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃতের নাম মুকুল ভৌমিক (৬৮)। কয়েক বছর আগেই মারা গিয়েছেন তাঁর স্বামী।
বাড়ির লোকের সঙ্গে পোষ্য রসি। শনিবার।
পরিবার সূত্রের খবর, কয়েক মাস আগে ওই আবাসনে আসেন তরুণ ও অনিতা সরকারের পরিবার। মুকুলদেবী অনিতার মা। তাঁর বড় মেয়ে নাগপুরে থাকায় বেশ কয়েক বছর ধরেই ছোট মেয়ে অনিতার কাছে ছিলেন ওই বৃদ্ধা। আবাসনের ওই ফ্ল্যাটেই থাকেন অনিতাদেবীর দুই ছেলে। ছোট ছেলে গৌরব জানান, এ দিন বেলায় ভাইফোঁটার জন্য তাঁরা সপরিবার ঢাকুরিয়ায় ঠাকুরমার বাড়ি গিয়েছিলেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা থাকায় ওই বৃদ্ধা বাড়ির বাইরে বেরোতেন না। তাই তাঁর জন্য খাবার তৈরি করে গিয়েছিলেন অনিতাদেবী। ঢাকুরিয়ায় ভাইফোঁটা শেষ করে সবে মাত্র দুপুরের খাওয়ার পর্ব শুরু হবে, তখনই এই খবর সেখানে পৌঁছয়।
গোটা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শ্যামল বিশ্বাস জানান, কুকুরের চিৎকার শুনেই তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন ঘরে কিছু একটা ঘটে গিয়েছে। বাড়িতে চুরি-ডাকাতি হয়ে থাকতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা করতে থাকেন। সে সময়েই শ্যামলবাবু লক্ষ করেন, জানলার একপাশ দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ‘‘এর পরেই কয়েক জন উপরে গিয়ে দরজা ভাঙতেই আগুনের হল্কা বেরিয়ে এল। দেখলাম, শরীরের বেশির ভাগ অংশটাই উপুড় হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে রয়েছে ওই বৃদ্ধার। দু’হাত ও গলার উপরের অংশ রয়েছে সোফার উপরে। আর সেই অবস্থায় দাউদাউ করে জ্বলছেন তিনি। গোটা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন,’’ বলেন শ্যামলবাবু।
এর পরেই দমকল ও পুলিশে খবর দেওয়া হয়। এতটাই আগুন ছিল যে, কেউ ঘরের ভিতরে ঢুকতে পারেননি। ক্রমেই ধোঁয়া বাড়ছিল। পরে দমকলের দু’টি ইঞ্জিন গিয়ে আগুন নেভায়। কিন্তু ততক্ষণে প্রায় সব শেষ। মুকুলদেবীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলে জানান চিকিৎসক। বারান্দা থেকে নীচে নামানো হয় রসিকে।
পুলিশ জেনেছে, নানা রকম অসুস্থতা থাকায় মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন ওই বৃদ্ধা। ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছে দেশলাইয়ের কাঠি। কেরোসিন তেলের গন্ধও পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি তদন্তকারীদের। এ ছাড়া, রসি যখন বারান্দায় ছিল, তখন ঘরের ভিতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল। পরিবারের দাবি, কাঠের দরজার বাইরে কোল্যাপসিবল গেটে তালা দেওয়া ছিল। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, কাঠের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। কোল্যাপসিবল গেটে তালা ছিল না।
ঘটনাস্থলে যান কলকাতা পুলিশের ডিসি (সাউথ সাবার্বান) রূপেশ কুমার। তিনি বলেন, ‘‘কী ভাবে আগুন লেগেছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’ সোফা-সহ ঘরের প্রায় সমস্ত আসবাব পুড়ে গিয়েছে। পরে ফরেন্সিক দল ঘরের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে। ঘটনার পরে যখন মোটরবাইকে করে রসিকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনও বাড়ির দিকে মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার করে চলেছে রসি।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy