ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলে মৃত্যু। রবিবার দুপুরে দক্ষিণ দমদম পুরসভার কাউন্সিলর সঞ্চিতা দত্তের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পরে প্রাথমিক তদন্তে এমনটাই অনুমান পুলিশের।
কিন্তু ঝুলন্ত বলতে দেহের অবস্থান কী ছিল, তা জানতে পারেনি পুলিশ। সঞ্চিতার ছোট ছেলে সায়ন ছাড়া আর কারা তাঁকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছিলেন? কারাই বা ওড়নার প্যাঁচ খুলে সঞ্চিতার দেহ নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন? পুলিশের দাবি, সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের সম্পর্কে তারা এখনও কার্যত অন্ধকারে।
এখানেই কাউন্সিলরের মৃত্যু ঘিরে তৈরি হয়েছে রহস্য। ঘটনাটি নিয়ে কিছু বলতে চাননি তৃণমূল নেতা-কর্মীরা, এমনকী পুলিশ-প্রশাসনও। তবুও স্থানীয় মহল থেকে উঠেছে নানা প্রশ্ন। যার জেরে ছড়িয়েছে জল্পনা।
প্রথমত, কাউন্সিলরের ফ্ল্যাটের দরজা কি ভিতর থেকে বন্ধ ছিল? স্থানীয় সূত্রে রবিবারই জানা গিয়েছিল, দুপুর ১টার কিছু পরে বাড়ি ফেরে সঞ্চিতার ছোট ছেলে সায়ন। সে দোতলার ফ্ল্যাট থেকে চাবি নিয়ে উপরে উঠে দরজা খুলে মাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে। তখন সঞ্চিতার স্বামী কৃষ্ণপদ দত্ত এবং বড় ছেলে অঙ্কুশ বাড়ির বাইরে ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, যদি কাউন্সিলর একাই ঘরে থাকবেন, তা হলে চাবি অন্যত্র দেওয়া হয়েছিল কেন? দুপুরে সঞ্চিতা যখন বাড়ি ফেরেন, তখন কৃষ্ণপদবাবু কোথায় ছিলেন? স্থানীয় সূত্রের খবর, তিনিও কাজে বাড়ির বাইরে ছিলেন। তা হলে দোতলার ফ্ল্যাটে চাবি কে দিল? কখন দিল?
এর পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, মাকে ওই অবস্থায় দেখে সায়ন কাকে জানিয়েছিল? স্থানীয় একটি সূত্র বলছে, এক মহিলা-সহ দুই তৃণমূল কর্মীকে তড়িঘড়ি কাউন্সিলরের ফ্ল্যাটে উঠতে দেখা গিয়েছিল। তার পরে খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন কৃষ্ণপদবাবু। পুলিশ বলছে, তারা এ দিকটিও খতিয়ে দেখছে। কিন্তু সে সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি।
প্রাথমিক ভাবে আত্মহত্যার ধারণা তৈরি হলেও সেখানেও খটকা রয়েছে। কারণ, তেমন পরিস্থিতি হলে সঞ্চিতার ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকার কথা।

গত বছর একটি অনুষ্ঠানে বিধায়ক সুজিত বসুর সঙ্গে সঞ্চিতাদেবী ও তাঁর স্বামী কৃষ্ণপদ দত্ত। নিজস্ব চিত্র
স্থানীয় ভাবে যে সব সূত্র মিলেছে, তাতে আরও বেড়েছে ধোঁয়াশা। রবিবারই দক্ষিণ দমদম পুরসভার এক চেয়ারম্যান পারিষদ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি তুলেছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, কাউন্সিলরের উচ্চতা আনুমানিক সাড়ে পাঁচ ফুট। ওজন ৭০ কেজির কাছাকাছি। সাধারণ বিছানার ক্ষেত্রে উচ্চতা হয় ২-৩ ফুট। টুল বা চেয়ারের উচ্চতাও প্রায় একই। সে ক্ষেত্রে সাড়ে ৯ থেকে ১০ ফুট উঁচু ঘরে সিলিং ফ্যান থেকে ঝোলা কি সম্ভব?
পাশাপাশি শুধু দরজা নিয়েই নয়, কী অবস্থায় দেহটি দেখা গিয়েছে, খটকা রয়েছে তা নিয়েও। ঘটনার দিন থেকে কখনও শোনা গিয়েছে, হাঁটু মুড়ে চেয়ারে বসা এবং গলায় ওড়না-পেঁচানো অবস্থায় দেহ মিলেছে কাউন্সিলরের। আবার কখনও শোনা যাচ্ছে, ওই কাউন্সিলরের একটি পা ছিল বিছানায়, অন্যটি টুলের উপরে। গলায় জড়ানো ছিল ওড়না। সেটির আর একটি অংশ সিলিং ফ্যানের হুকের সঙ্গে লাগানো ছিল।
তবে এই প্রসঙ্গে বিধাননগর পুলিশের দাবি, কাউন্সিলরকে আর জি করে নিয়ে যাওয়ার পরে তারা খবর পায়। ময়না-তদন্তের জন্য মর্গে ঢুকিয়ে দেওয়ায় হাসপাতালে গিয়েও তারা দেহ দেখতে পায়নি। ফলে কোনও ছবিও পাওয়া যায়নি।
আবার, লেক টাউনের এস কে দেব রোডে সঞ্চিতার বাড়িও ছিল তালাবন্ধ। ফলে ঘটনাস্থল পরীক্ষার জন্য রবিবার অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় পুলিশকে। এ ক্ষেত্রে তাই ময়না-তদন্তের রিপোর্টের উপরেই তারা নির্ভর করছে। কিন্তু এমন কেন ঘটল, তা নিয়ে স্থানীয় বা রাজনৈতিক সূত্রের ইঙ্গিত ছিল কাউন্সিলরের পারিবারিক অশান্তির দিকে।প্রাথমিক তদন্তে পুলিশও জেনেছে, সঞ্চিতার পরিবারে অশান্তি ছিল।
তৃণমূলের দলীয় সূত্রেরও খবর, ওই নেতা-নেত্রীর পারিবারিক অশান্তির বিষয়ে দলের একাংশ অবহিত। সঞ্চিতার সঙ্গে নিয়মিত অশান্তি চলত তাঁর স্বামীর। কেউ কেউ এ-ও বলছেন, মানসিক অত্যাচারের পাশাপাশি সঞ্চিতার উপরে শারীরিক অত্যাচারও করা হতো। যদিও অত্যাচারের বিষয়টি তৃণমূলের নেতারা মানতে চাননি। এই সম্পর্কে কাউন্সিলরের পরিবারের তরফেও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। যদিও প্রাথমিক তদন্তে একটি সূত্র মারফত পুলিশ জেনেছে, রবিবার সকালেও অশান্তি হয়েছিল। সেই তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় কৃষ্ণপদবাবুকে ফোন করা হলে এক ব্যক্তি ফোন ধরে বলেন, ‘‘উনি অসুস্থ। কথা বলার অবস্থায় নেই।’’
দক্ষিণ দমদম পুরসভায় এ দিন সঞ্চিতার স্মরণে একটি সভা হয়। কাউন্সিলর ছাড়াও পুরকর্মীরা হাজির ছিলেন সেখানে।