Advertisement
০২ মে ২০২৪

আস্থা চুরচুর, লুকিয়েই বাঁচতে হল নিধিরাম পুলিশকে

পানশালার প্রায় গায়ে লাগানো আইনরক্ষকের আস্তানা। কলকাতা পুলিশের কিয়স্ক। সেখানে দু’জন পুলিশও মজুত। কিন্তু তাঁরা মাথা গুঁজে বসে। রাস্তার মোড়ে এতক্ষণ যে জনা চারেক পুলিশকর্মীকে দেখা যাচ্ছিল, তাঁরাও নিমেষে উধাও!

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৫ ০৪:১৬
Share: Save:

পানশালার প্রায় গায়ে লাগানো আইনরক্ষকের আস্তানা। কলকাতা পুলিশের কিয়স্ক। সেখানে দু’জন পুলিশও মজুত। কিন্তু তাঁরা মাথা গুঁজে বসে। রাস্তার মোড়ে এতক্ষণ যে জনা চারেক পুলিশকর্মীকে দেখা যাচ্ছিল, তাঁরাও নিমেষে উধাও!

কারণ, পানশালার সামনে তখন ধুন্দুমার। বৃষ্টির মতো বোমা পড়ছে। এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে দশ-বারোটা ছেলে। এক জন তো কিয়স্কের ছাদে উঠে পড়েছে। ভেসে আসছে চিৎকার, ত্রাসের আর্তনাদ। অথচ নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়ার ভার যাদের, তাঁরাই মুখ লুকিয়ে!

অবাধ পরাক্রম দেখিয়ে, ক’মিনিটের মধ্যে ৩০-৩৫ রাউন্ড গুলি চালিয়ে হামলাকারীরা যখন বিদায় নিল, তখন চার দিকে যুদ্ধশেষের ছবি। এ বার হরিদেবপুর থানা থেকে পুলিশবোঝাই ভ্যান এল। বুকে বল পেয়ে কিয়স্ক খুলে পুলিশ বেরোল। মোড়ে মোতায়েন পুলিশকর্মীরাও ফিরে এলেন একে একে। দেখা গেল, রাস্তায় পড়ে আছে এক যুবকের রক্তাক্ত দেহ। গুলিবিদ্ধ দু’টি ছেলের হাত থেকে রক্ত ঝরছে। এক হামলাকারীও ধরা পড়ে গিয়েছে স্থানীয় মানুষের হাতে।

বুধবার রাতের এই কাণ্ড দেখে স্বাভাবিক ভাবেই আমজনতার মনে প্রশ্ন উঠেছে, দুষ্কৃতীর ভয়ে পুলিশ যেখানে আগল তুলে বসে থাকে কিংবা বেমালুম গায়েব হয়ে যায়, সেখানে জনগণের নিরাপত্তা কোথায়? যার মুখে পড়ে পুলিশের নিচুতলার একাংশ আঙুল তুলছে লালবাজারের দিকে। ‘‘রাতের কলকাতায় যদি নিরস্ত্র পুলিশকে কিয়স্কে বসিয়ে রাখা হয় এবং সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা যদি সংখ্যায় বেশি হয়, তা হলে এর বেশি কিছু আশা করা উচিত কি?’’— পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন উত্তর কলকাতার এক থানার এক এসআই। কিন্তু হরিদেবপুরে যা ঘটে গেল, তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি ধাক্কা খাবে না? মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত একটি থানার এক এএসআইয়ের জবাব, ‘‘আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ক্রিমিন্যাল ধরব, আর নেতারা থানায় চড়াও
হয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন! এই তো নিয়মে দাঁড়িয়েছে। বাহিনীর ভাবমূর্তি আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি?’’ তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘মানুষ এখন উর্দিকে ভয় পায় না। তাই অপরাধীদের পোয়া বারো।’’

বস্তুত শাসকদলের নেতা-নেত্রীরা আমজনতার চোখে পুলিশকে কী ভাবে দিনকে দিন হেয় করে তুলেছেন, তার তালিকা তৈরি হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন ব্যারাকে। ফি মাসে পুলিশ-নিগ্রহের একটা-দু’টো ঘটনা জুড়ে তালিকা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। আলিপুরে তৃণমূল সমর্থকদের হাত থেকে মাথা বাঁচাতে ফাইল হাতে থানার টেবিলের তলায় ঢুকতে হয়েছিল পুলিশকে। সে ছবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন টালিগঞ্জ ট্রাফিক গার্ডের এক কনস্টেবল। লেকটাউনে ও রাজারহাটে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে দুই তৃণমূল সাংসদের হাতে হেনস্থা হওয়া কনস্টেবল ও গ্রিন পুলিশের ছবিও রয়েছে তাঁর ‘ফাইলে।’ রাসবিহারীর মোড়ে মেয়রের ভাইঝির হাতে নিগৃহীত কনস্টেবলের ছবিও বাদ নেই। ‘‘ওঁদের দেখি আর ভাবি, কোনও দিন হয়তো আমারও এ অবস্থা হবে!’’— বলছেন টালিগঞ্জের ওই ট্রাফিক কনস্টেবল।

শাসকের প্রশ্রয়ে আইন না-মানার এ হেন প্রবণতা দেখে প্রাক্তন অনেক অফিসারও উদ্বিগ্ন। কলকাতা পুলিশের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কথায়, ‘‘গার্ডেনরিচ থেকে শুরু করে গিরিশ পার্ক— প্রতিটা ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, পুলিশের উপরে হামলাকারীদের পিছনে শাসকদলের কোনও না কোনও নেতা দাঁড়িয়ে পড়ছেন! ফলে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ আগেভাগে পদক্ষেপ করতে চাইছে না।’’ পুলিশের নিচুতলার অভিযোগ, কলকাতা পুরভোটের আগে গোপালনগর মোড়ে পুলিশ নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার আগাম জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল লালবাজারের একাংশকে দিয়েই। আবার শাসকদলের একাংশের হস্তক্ষেপেই গিরিশ পার্কে পুলিশের উপরে গুলিচালনার ঘটনায় অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারিকে ধরতে লালবাজার টালবাহানা করেছে বলে মনে করছে নিচুতলার কেউ কেউ।

বাহিনীর অন্দরের এই ক্ষোভকে এ বার শাসকদলের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইছে বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘এ আর নতুন কী? তৃণমূল তো পুলিশের বদলে দলের লোকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিচ্ছে! পরিণাম, অরাজকতা।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘আজ হরিদেবপুরে হয়েছে, কাল খাস ধর্মতলায় হতে পারে! এ রাজ্যে সমাজবিরোধীরা বুঝে গিয়েছে, তারা শাসকদলের ছাতার তলায় ঢুকে পড়লেই পুলিশের জারিজুরি শেষ। নেতারা বলবেন, যৌবনের উচ্ছলতায় অমন একটু-আধটু হয়ে যায়!’’ কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানের প্রতিক্রিয়া, ‘‘পুলিশ বুঝেছে, তার পাশে কেউ নেই। তাদের মনোবল ভেঙে গিয়েছে।’’

শাসকদলের কী বক্তব্য?

পুলিশের উপরে দলীয় প্রভাবের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ‘‘পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। পুলিশকে হেনস্থা বরদাস্ত করা হবে না। এর মধ্যে রাজনীতির কোনও ব্যাপার নেই।’’— দাবি পার্থবাবুর। হরিদেবপুরে হামলার সময়ে পুলিশকে মুখ লুকোতে হল কেন, সে প্রশ্নের জবাবে পার্থবাবুর যুক্তি, ‘‘কিয়স্কে তো পুলিশের অস্ত্র থাকে না। তা ছাড়া অস্ত্র থাকলেও এক-দু’জন পুলিশ চল্লিশ জনের মোকাবিলা কী ভাবে করবে?’’

কিন্তু রাত-পাহারার পুলিশকে এ ভাবে ঠুঁটো করে রাখা হয় কেন?

কর্তাদের কাছে এর সদুত্তর মেলেনি। বরং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, হরিদেবপুরের ঘটনাটি সম্পর্কে তিনি তেমন কিছু জানেনই না। তাঁর কথায়, ‘‘ওখানকার কিয়স্কের পুলিশের কাছে অস্ত্র ছিল কি না, আমার জানা নেই। স্থানীয় ডিসি-কে বলব ব্যাপারটা যাচাই করতে।’’ লালবাজার সূত্রের খবর: পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ এ দিন হরিদেবপুর-কাণ্ড নিয়ে পদস্থ পুলিশ-কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানে নামার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু রাত-পাহারার পুলিশকে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে কোনও আলোচনা হয়নি।

হরিদেবপুরে গোলমালের সময়ে পুলিশ কেন সামনে এল না?

এ ক্ষেত্রেও ভাসা-ভাসা উত্তর মিলেছে। ‘‘যত দূর জানি, পুলিশই এক জনকে ধরিয়ে দিয়েছে। তবে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ যখন উঠেছে, ডিসি’কে তদন্ত করতে বলব।’’— জবাব দিয়েছেন যুগ্ম কমিশনার (সদর)। সব মিলিয়ে কর্তাদের কথায় ভরসার বিশেষ জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না নিচুতলার পুলিশ। এমতাবস্থায় আইনরক্ষকের উপরে আমজনতার আস্থা আদৌ থাকবে কিনা, পুলিশের অন্দরেই সে সংশয় বিলক্ষণ প্রকট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE