এ যেন খাস কলকাতায় যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন’!
তবে উর্দিধারী পুলিশের বদলে এখানে বাহিনীর সদস্যরা কলকাতা ও লাগোয়া এলাকার বাছাই করা দুষ্কৃতী। সেই দলে ছিল শাসক দলের কয়েক জন সক্রিয় কর্মীও। শনিবার গিরিশ পার্ক কাণ্ডে মহম্মদ কামাল, কলিম খান ওরফে চিনা এবং তারক কোটাল ওরফে বাবলিকে গ্রেফতার করার পর এমনটাই দাবি করছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা জানান, ১৮ এপ্রিল গিরিশ পার্কের সিংহী বাগানে কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলি করার ঘটনায় গোপাল তিওয়ারির নামই মূল চক্রী হিসেবে উঠে এসেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই কাণ্ডে মেছুয়া এলাকার দুষ্কৃতী রাজা শর্মা ওরফে মোটা রাজার ভূমিকাও স্পষ্ট হচ্ছে।
পুলিশের দাবি, গোপালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওই দিন শাসক দলের হয়ে ‘ভোট-অপারেশনে’ ছিল মোটা রাজাও। শনিবার গ্রেফতার হওয়া কামাল ও চিনা দু’জনেই রাজার ঘনিষ্ঠ শাগরেদ বলে দাবি। বাবলি অবশ্য গোপালের গ্যাংয়ের হয়েই কাজ করত। রবিবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে বিচারক তাদের ১৫ মে পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।
ধৃতদের জেরা করে পুলিশ জানায়, ভোটের কাজ করার জন্য গোপাল যেমন তার বাহিনী নামিয়েছিল, তেমনই রাজাও নিজের দলবলকে নামিয়েছিল। দু’টি আলাদা দল হলেও গোপাল ও রাজার মধ্যে তেমন কোনও শত্রুতা ছিল না। ফলে মধ্য কলকাতার এক নেতার নির্দেশে দু’টি দলই মধ্য কলকাতার ৬-৭টি ওয়ার্ডে ভোটের দিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। গিরিশ পার্কে হাঙ্গামার সময় দু’দলের সদস্যরা দু’টি দিক থেকে আক্রমণ করেছিল বলে পুলিশের দাবি।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মেছুয়া এলাকায় রাজার বিরুদ্ধে অবৈধ নির্মাণ ও তোলাবাজির অভিযোগ রয়েছে। ওই এলাকার পরিবহণ ব্যবসায়ীদের একাংশের সঙ্গেও রাজার সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছে পুলিশ। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘গোপালের মতো বহরে বড় না হলেও মেছুয়া এলাকায় রাজার দাপট গত কয়েক বছরে বেড়ে গিয়েছিল।’’ কামাল ও চিনা রাজার ঘনিষ্ঠ শাগরেদ হিসেবেই কাজ করত। এলাকায় কয়েক জন ব্যবসায়ীকে কালাম তোলা চেয়ে হুমকি দিয়েছিল বলেও পুলিশের দাবি।
পুলিশের একাংশ বলছে, শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে রাজার ঘনিষ্ঠতার জন্যই তাদের দাপট এত বেড়ে গিয়েছিল। শনিবার একটি ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে জোড়াসাঁকো এলাকার বিধায়ক স্মিতা বক্সীর সঙ্গে কামাল ও চিনাকে দেখা যাচ্ছে। সেই ছবিতে রয়েছে রাজাও। স্মিতাদেবী অবশ্য কামালদের চেনেন না বলেই দাবি করেছেন। প্রসঙ্গত, জগন্নাথবাবু গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেই গিরিশ পার্কে তৃণমূলের একটি দলীয় অফিস থেকে অশোক শাহ এবং দীপক সিংহ নামে দুই তৃণমূলকর্মীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
কী ভাবে কামালদের হদিস পেল পুলিশ? পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, দিন কয়েক আগে এই ঘটনায় জড়িত হিসেবে কামাল ও চিনার নাম উঠে আসে। কিন্তু এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা ভোটের পর থেকেই এলাকা ছাড়া। তাতেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। বৃহস্পতিবার রাতে বীরভূমের নলহাটিতে হানা দিয়ে গোপালের ঘনিষ্ঠ শাগরেদ সমীর দাস ওরফে ছোট্টুকে পাকড়াও করা হয়। রাতভর টানা জেরার ফলে সে যেমন গোপালের বাড়ির অস্ত্রাগারের খোঁজ দেয়, তেমনই ওই ঘটনায় রাজা, কামাল, চিনার নামও জানায় সে। শনিবার সকালে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, কামাল ও চিনা এলাকায় ঢুকছে। সেই মতো ফাঁদ পেতে দু’জনকে ধরা হয়। ঘটনার পর থেকে এলাকা ছাড়া ছিল বাবলিও। শনিবার সন্ধ্যায় সে এলাকা ছাড়ার ছক কষলে ধর্মতলার বাস গুমটি থেকে তাকে পাকড়াও করা হয়। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, বাবলিও জেরায় অনেক তথ্য দিয়েছে। সেগুলি ছোট্টুর দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলছে।
লালবাজার সূত্রে খবর, গোপালের বাড়ির অস্ত্রাগার নিয়েও তদন্ত শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। এই সূত্রেই বন্দর এলাকার এক বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। বন্দর এলাকার দুষ্কৃতীদের অস্ত্র বিক্রি করা ওই ব্যবসায়ীর থেকেই পিস্তল ও বিস্ফোরক কিনেছিল গোপাল। তার হয়ে এই কাজ করেছিল ছোট্টু। পুলিশের একাংশ জানান, গোপালের বাড়ির অস্ত্রাগারের সূত্রে ওই ব্যবসায়ীর খোঁজও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বন্দর এলাকার এক প্রভাবশালী নেতার যোগাযোগ রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
ছাড়া পেলেন এস আই। পনেরো দিন বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-এ থাকার পরে রবিবার সকালে বেহালায় নিজের বাড়িতে ফিরলেন গিরিশ পার্ক-কাণ্ডে গুলিবিদ্ধ এস আই জগন্নাথ মণ্ডল। তবে অস্ত্রোপচারের ক্ষত না শোকানোয় তাঁকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। পাশাপাশি ভোটের দিন দু’পক্ষকে থামাতে গিয়ে যে ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি, সেই আতঙ্ক এখনও পিছু ছাড়েনি তাঁর। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার জন্য।