অসহনীয়: নিয়মিত বেশি থাকছে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ। ছবি: সুমন বল্লভ ও সুদীপ্ত ভৌমিক
কালীপুজোর রাতকেও হার মানাল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দূষণ! যা নিয়ে পরিবেশকর্মী ও গবেষকেরা শুধু বিস্মিতই নন, উদ্বিগ্নও বটে। কারণ, এত দিন শহরে দূষণের লেখচিত্র কেমন, তা প্রকাশ করতে কালীপুজো-দীপাবলির দূষণকেই একটি মাপকাঠি ধরা হত। ভাবা হত, বাজি পোড়ানোর জেরে ওই সময়েই দূষণ সর্বাধিক থাকে। কিন্তু সেই দূষণ-চিত্রেই উলটপুরাণ ঘটেছে চলতি বছরে। ডিসেম্বরের গত কয়েক দিনের দূষণ-মাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, তা কালীপুজোর থেকেও বেশি! প্রসঙ্গত, গত ৬ নভেম্বর ছিল কালীপুজো। তার এক মাস পরে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, বরং দূষণমাত্রা ধারাবাহিক ভাবেই নিজের ‘পারফরম্যান্স’ বজায় রেখেছে।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, এ বছর কালীপুজোর রাত ১২টায় বি টি রোডের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার (পিএম ১০) পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫৩৭.৬৬ মাইক্রোগ্রাম এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) পরিমাণ ছিল ৪৭১.৩৫ মাইক্রোগ্রাম। ওই রাতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল ৬০৯.৮৬ মাইক্রোগ্রাম এবং পিএম ২.৫ ছিল ৫৩৯.০৭ মাইক্রোগ্রাম। এতেই তখন উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন পরিবেশকর্মী ও গবেষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও, যাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন।
কিন্তু সে সব এখন অতীত, বলছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য। সেই তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অন্তত দু’দিন দূষণের পরিমাণ সহন-মাত্রার চেয়ে ছ’গুণ বেশি ছিল। আর বৃহস্পতিবার তা ছিল সাত গুণ বেশি! গত ৪ ডিসেম্বর রবীন্দ্র ভারতী চত্বরে রাত ১১টায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৬০১.৪৭ মাইক্রোগ্রাম। স্পষ্টতই যা এ বছরের কালীপুজোর রাতের থেকেও বেশি। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। কারণ, এক ঘণ্টা পরেই, রাত ১২টায় সেই মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২২.৩ মাইক্রোগ্রামে। তার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ওই দূষণ। বুধবার রাত ১২টায় রবীন্দ্র ভারতী চত্বরে পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল ৬০৮.২ মাইক্রোগ্রাম এবং পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ছিল ৩৫৩ মাইক্রোগ্রাম। বৃহস্পতিবার রাতে সেটাই বেড়ে সহন-মাত্রার থেকে সাত গুণ বেশি হয়ে যায়! সে দিন রবীন্দ্র ভারতী চত্বরে রাত ১২টায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল ৭৩৪.২ মাইক্রোগ্রাম এবং পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ছিল ৩৯৫.৪ মাইক্রোগ্রাম। শুক্রবার সকাল ন’টাতেও ওই চত্বরেই পিএম ১০-এর পরিমাণ ৬০৪.৩ মাইক্রোগ্রাম।
ঘটনাচক্রে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দূষণ গত পাঁচ বছরের কালীপুজোর দূষণকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। ব্যতিক্রম একমাত্র ২০১৪ সালের কালীপুজো। ২০১৩ সালের কালীপুজোর রাত ১২টায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫২৭.৭ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ওই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬৮১.৯৫, ১৪৩.১১ এবং ৩১৭.৯৫ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৪ সালে একমাত্র ওই পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১৩২০.২৫ মাইক্রোগ্রামে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সুবর্ণা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শীতে বাতাসের গতিই থাকে না। সেটা একটা কারণ দূষণের। কিন্তু দূষণের অন্য যে উৎসগুলিও ক্রমাগত বাড়ছে।’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত জানাচ্ছেন, দূষণের জন্য জাতীয় পরিবেশ আদালত রাজ্য সরকারকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করা সত্ত্বেও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। তাই শুধু জরিমানা করে হবে না, বরং জরিমানার পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হবে। সুভাষবাবুর কথায়, ‘‘পরিবেশ আদালতে আবেদন জানাব, আর্থিক জরিমানা না করে গাছ লাগাতে আদেশ দেওয়া হোক। কারণ, জরিমানা দিয়ে দেওয়া যাবে। তাতে দূষণের খুব একটা হেরফের হবে না। কিন্তু গাছ লাগিয়ে তা বড় করে তুলতে হবে প্রশাসনকে। এটাই জরিমানা হিসেবে ধার্য হবে ও পরিবেশের পক্ষে সহায়ক হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy