সহিষ্ণুতা নিয়ে আলোচনা, কিন্তু রাজনীতি থাকবে না। সাম্প্রতিক সময়ে তা-ও কি সম্ভব?
৪০তম কলকাতা বইমেলার সাহিত্য উৎসবে ‘অসহিষ্ণুতা সহিষ্ণু ভারতে’ শীর্ষক আলোচনাকে ঘিরে তেমনই বিতর্ক দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি ওই আলোচনা হওয়ার কথা তৃতীয় ‘কলকাতা সাহিত্য উৎসব’-এর উদ্বোধনের দিন।
সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে কলকাতা বইমেলা। তার আগে শনিবার গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় মিলন মেলায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘‘আমরা কোনও রাজনীতির পক্ষে নই। যাঁরা রাজনীতির গন্ধ খুঁজছেন, খুঁজতে পারেন। ওই আলোচনাসভায় যাঁরা আসছেন, তাঁরা কেউ প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।’’
কলকাতা সাহিত্য উৎসবের ওই আলোচনায় যাঁরা থাকবেন, তাঁদের অন্যতম হিন্দি কবি অশোক বাজপেয়ী এবং অধ্যাপক কবিতা পঞ্জাবি। ইতিমধ্যেই অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে কবি অশোক বাজপেয়ীর রাজনৈতিক মতামত স্পষ্ট। এ নিয়ে তাঁর মন্তব্য ও ভূমিকা দেশে আলোড়ন ফেলেছে। অসহিষ্ণুতার বিরোধিতায় সাহিত্যিক কালবুর্গির হত্যার পরেই সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়েছিলেন তিনি। এখন হায়দরাবাদে দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিটও ফেরত দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি এটা ফেরত দিচ্ছি। কারণ আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক চাপের মুখে কাজ করছে।’’ শনিবার ফের জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন তিনি। রোহিতের মৃত্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদক্ষেপকে বলেছেন ‘বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া’। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘এক জননীর সন্তান হারানোর দিকটিতে যে ভাবে জোর দিলেন প্রধানমন্ত্রী, তাতে দলিত-প্রসঙ্গটাই লঘু হয়ে গেল। সমস্যার সমাধানের জন্য সেটাই তো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল।’’ তিনি বিশ্বাস করেন, ওই দলিত ছাত্র বাধ্য হয়েছিলেন আত্মহ্যার পথ বেছে নিতে। ‘‘এখন বলছে ঘটনাটির তদন্তে বিচারবিভাগীয় কমিশন হবে। খুব ভাল কথা। কিন্তু ছ’দিন দেরি কেন? বিষয়টি থিতিয়ে দেওয়ার জন্য?’’ প্রশ্ন তুলেছেন বাজপেয়ী। মোদী সরকারকে নিন্দা করে এ দিন জয়পুরে তিনি আরও বলেছেন, ‘‘কেউ এ সরকারের সঙ্গে একমত না হলেই এখন দেশদ্রোহী বলা হয়।’’ এই আচরণকে ‘উৎকৃষ্ট মানের অসহিষ্ণুতা’ বলেও মনে করেন তিনি। অধ্যাপক কবিতা পঞ্জাবিও গুজরাত দাঙ্গার সময় থেকেই বুঝিয়ে এসেছেন অসহিষ্ণুতার পিছনে সর্বদা থাকে রাজনীতি।
এমন ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে এক মঞ্চে অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে আলোচনা হলে কি তা কখনও পুরোপুরি রাজনীতি-বর্জিত হতে পারে?
অধুনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা কবি সুবোধ সরকারের কথায়, ‘‘অসহিষ্ণুতা একটা গরম আলুর মতো। হাতে ধরে রাখা যায় না। আলোচনা রাজনীতিমূলক হবে নাকি ধর্মমূলক, সেটা প্যানেলে কারা বসছেন তাঁদের উপরে নির্ভর করে। তবে যেহেতু অশোক বাজপেয়ী আছেন, তাই প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে রাখছি।’’
২০১১ সালে কলকাতা বইমেলাতেই তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছিল তৃণমূল। পরে গিল্ড জানিয়েছিল, বইমেলায় আর রাজনীতির প্রসঙ্গ আসবে না। তা কি মনে রাখছেন না বইমেলা কর্তৃপক্ষ? সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিববাবুর কথায়, ‘‘আগে কী হয়েছে, সে প্রসঙ্গে যাব না। ২০১৬-র কথা বলছি। প্যানেলে যাঁরা বসবেন তাঁদের বলা হয়েছে, আলোচনা যেন রাজনীতি কেন্দ্রিক না হয়।’’
যদিও ত্রিদিববাবুদের এমন বক্তব্যকে মান্যতা দিতে রাজি নন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘এটা ভাবের ঘরে চুরি। অসহিষ্ণুতার আলোচনায় রাজনীতি আসবেই। গিল্ড এক সময়ে বলেছিল বইমেলায় রাজনীতি হবে না। জওহরলাল নেহরুর বাণীও রাখা যায়নি। তবে কার স্বার্থে এখন হঠাৎ অসহিষ্ণুতার আলোচনার মধ্যে দিয়ে রাজনীতি আনা হচ্ছে, সেটা ভাবার বিষয়।’’ কার্যত একই বক্তব্য বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যেরও। তাঁর কথায়, ‘‘কোন পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা থেকে গিল্ড এটা করছে, সেটা দেখতে হবে।’’ সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের আবার প্রশ্ন, ‘‘অসিহষ্ণুতা নিয়ে সেমিনার ভাল, তবে বইমেলায় অন্য রাজনৈতিক বিষয়েও আলোচনা করা যাবে তো?’’ তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদেশদর্শী। িগল্ডকে চাপ দিয়ে নিজেই যে নিয়ম করেছিলেন, এখন নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে তা ভাঙায় প্রশ্রয় দিচ্ছেন। কারণ, এই রাজনৈতিক আলোচনা মমতাকেই সুবিধা দেবে।’’
সরাসরি না বললেও এমন সংশয় কিছুটা ধরা পড়ে যায় খোদ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের মন্তব্যে। তিনি বলেন, ‘‘অসহিষ্ণুতা দু’ধরনের, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক। যদি সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতা নিয়ে আলোচনা হয়, কিছু বলার নেই। তবে সেটি যদি রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার বিষয় হয়, তবে পূর্ণাঙ্গ আলোচনাই হওয়া উচিত বলে মনে করি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy