E-Paper

পার্সি-ইতিহাসে এ বার অগ্নিকাণ্ডের জবরদখল!

এজ়রা স্ট্রিট এবং পার্সি চার্চ স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ‘রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি পার্সি ফায়ার টেম্পল’ তৈরি হয় ১৮৩৯ সালে। উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেনদ্বারকানাথ ঠাকুর।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৩০
অবশেষ: বিধ্বংসী আগুনে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এজ়রা স্ট্রিটের আলো এবং বৈদ্যুতিক সামগ্রীর দোকানগুলি। রবিবার।

অবশেষ: বিধ্বংসী আগুনে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এজ়রা স্ট্রিটের আলো এবং বৈদ্যুতিক সামগ্রীর দোকানগুলি। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

মূল উপাস্য অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ড নিভে গিয়েছে আগেই। নষ্ট হয়ে গিয়েছে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে থাকা রঙিন ঘষা কাচ। অগ্নিকুণ্ডের আলো পড়েসেই ঘষা কাচে সদা দৃশ্যমান সৃষ্টিকর্তা আহুরা মাজদা, ধর্ম প্রবর্তক জ়রথুস্ট্র, পশুপাখি, উদ্ভিদকুল, আকাশ, মাটি ইত্যাদির এক একটি দিব্যমূর্তিও নষ্ট হয়ে গিয়েছে বহু দিন। এটাই যে এ শহরের প্রথম পার্সি গির্জা, তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না, যদি না রাজ্য সরকারের হেরিটেজ বোর্ড চোখে পড়ে।

কারণ, এই গির্জাকে চারদিক থেকে ঘিরে থাকত নামে-বেনামে খোলা আলোর দোকান। কোনওটি ডালা পেতে। কোনওটির জন্য আবার পাকা সিমেন্টে বাঁধিয়ে নেওয়া হয়েছে যাবতীয় নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। গির্জার তালা দেওয়া গেটের সামনেও স্তূপ করে রাখা থাকত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বস্তা। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীর ছাপ রাখা দেওয়াল জুড়ে ঝোলে বিকিকিনির জন্য জমা করে রাখা আলোর চেন। দেওয়ালের আস্তরণ উঠিয়ে সেখানেই পেরেক পুঁতে ঝোলানো থাকে পর পর ঝাড়লণ্ঠন, ‘সাইনবোর্ড’!বাদ যায়নি রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন বহনকারী গির্জার স্তম্ভগুলিও। সেগুলিতেও বেআইনি নির্মাণকাজ চলছিল, আলোর দোকান পাততে সুবিধা হবে বলে! কার্যত জতুগৃহের চেহারা ছিল আশপাশে।শুক্রবারের আগুনে বিধ্বস্ত গির্জার দেওয়াল ঠান্ডা করতে শনিবারেও দমকলের চারটি ইঞ্জিন দিনভর কাজ করেছে।

‘‘কিন্তু যে ভাবেই থাকুক, তবু তো ছিল।’’— কথাটা বলেই কিছুটা থমকালেন কলকাতার হাতেগোনা পার্সিদের মধ্যে এক জন জিমি বিলিমোরিয়া। ময়দানে পার্সি ক্লাবের সামনে চেয়ারে বসা অশীতিপর বৃদ্ধের আশঙ্কা, শনিবার ভোরের অগ্নিকাণ্ডের পরে কোনও মতে টিকে থাকা শহরের এই ইতিহাস এ বার মাটিতে মিশে যেতে পারে। তিনি বললেন, ‘‘আগুনটা লেগে গিয়েছে, না কি লাগানো হয়েছে, সেটা আগে তদন্ত হওয়া দরকার। বছরের পর বছর ধরেধীরে ধীরে এমন ইতিহাস এই ভাবে জবরদখল হয়ে যাবে, মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু ক্ষমতাও নেই যে আটকাব!’’

শুধু তাঁরই নয়, এই দাবি এজ়রা স্ট্রিটের যে তল্লাটে আগুনটি লেগেছে, সেখানকার অনেকেরই। তাঁদের দাবি, জবরদখলের ব্যবসায় বহু দিন থেকেই বাঁধা হয়ে রয়েছে পুরসভার ঘোষণা করা ‘গ্রেড-ওয়ান’তালিকাভুক্ত এই পার্সি গির্জা। এ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আইনি লড়াই চলছে। জানা যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া গির্জাটি ২৬, ২৭ এবং ৩১, এজ়রা স্ট্রিট, এবং ১৯,পার্সি চার্চ স্ট্রিট— জুড়ে বিস্তৃত। এই বিশাল এলাকার জন্য একশোরও বেশি দোকানদার বা রিয়্যাল এস্টেট ডেভেলপার, কেউই পিছু হটতে রাজি নন।

পুরসভার দল দোকানদার এবং রিয়্যাল এস্টেট ডেভেলপারের মধ্যে মুখোমুখি সংঘাতেরও সাক্ষী হয়েছে, যা মারামারির পর্যায়ে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এত দিন গির্জাটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা বৃদ্ধ মহম্মদ ইসলাম হকের মৃত্যুর পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এর মধ্যেই পুরসভার ঐতিহ্য রক্ষাকারী দলের সদস্যদের জায়গাটি পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কিন্তু তাঁরা সবটা দেখতেই পারেননি জবরদখলের দাপটে।

ফলে অনেকেরই প্রশ্ন, পথের কাঁটা সরাতেই কি এই অগ্নিকাণ্ড? পুলিশ যদিও দমকলের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে তদন্ত চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে।

এজ়রা স্ট্রিট এবং পার্সি চার্চ স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ‘রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি পার্সি ফায়ার টেম্পল’ তৈরি হয় ১৮৩৯ সালে। উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেনদ্বারকানাথ ঠাকুর। এই গির্জা থেকেই রাস্তার নামকরণ হয় পার্সি চার্চ স্ট্রিট। সেই সময়ে কলকাতায় প্রায় এক লক্ষ পার্সির বাস ছিল বলে জানা যায়। এই শহরে গড়ে উঠতে পার্সিদের অবদান অনস্বীকার্য। রুস্তমজিকাওয়াসজি বানাজি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, কলকাতা কর্পোরেশন এবং খিদিরপুর ও সালকিয়া ডক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৮৬৬ সালে, তাঁদের আদি অগ্নিমন্দির এই গির্জায় বসেই কলকাতার পার্সি ট্রাস্টের পত্তন করেন শহরের তিন পার্সিব্যবসায়ী— রুস্তমজি, কাওয়াসজি পেস্টনজি এবং নওরোজি পেস্টনজি ডালা। ইরান থেকে ছিন্নমূল পার্সিরা ভারতে প্রথম এসে পা রাখেন গুজরাতের নভসারিতে। সেখানেই এখনও সযত্নে রক্ষিত পার্সিদের পবিত্র আগুন। কলকাতার মেটকাফ স্ট্রিটের অগ্নিমন্দিরেরআগুন নভসারি থেকেই আসে। হাতে ধরে, ৭৩ দিন ধরে পায়ে হেঁটে। সেই আগুনের সঙ্গে কাঠের ছোঁয়া লাগা বারণ বলে, কাঠের তক্তা ফেলা হাওড়ার পন্টুন ব্রিজ পেরোনো হয়েছিল লোহার খড়ম পরে। কথাগুলো বলতে বলতে পার্সি ট্রাস্টেরঅন্যতম সদস্য নুমি মেটা যেন চলে গিয়েছেন পুরনো সেই দিনে। বলে উঠলেন, ‘‘ধীরে ধীরে ছেলেমেয়েরা কাজের সূত্রে বাইরে চলে গেল। এখন কলকাতায় আমরা কয়েক ঘর পার্সিই রয়ে গিয়েছি। কিছুই ধরে রাখতে পারিনি। হয়তো এই চার্চটাও ধরে রাখতে পারলাম না।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fire Church

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy