আবাসনে ভাঙচুর হওয়া গাড়ি দেখছেন বিমা সংস্থার প্রতিনিধি। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র
উইন্ডস্ক্রিন ভাঙা অধিকাংশের। কয়েকটির বনেটও। ঘটনার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পরেও ৩৬ বি পণ্ডিতিয়া টেরাসে তাণ্ডবের চিহ্ন বহন করছে ভাঙাচোরা ওই গাড়িগুলি। কিছু গাড়ি মেরামতিতে পাঠানো হয়েছে। আরও কিছু গাড়িকে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। আবাসনের সামনে বসানো হয়েছে পুলিশি প্রহরা। তবু আতঙ্ক কাটছে না সেখানকার বাসিন্দাদের। সোমবারও ধ্বংসলীলার আতঙ্কের রেশ স্পষ্ট আবাসনের থমথমে পরিবেশে।
শনিবার গভীর রাতে হাজরা মো়ড়ে একটি বিলাসবহুল গাড়ি ধাক্কা মারে একটি স্কুটিতে। ওই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এক যুবকের। আহত হন দু’জন। মৃত যুবক ওই তল্লাটের একটি বস্তির বাসিন্দা। সেই গাড়িতে রাখা একটি কাগজে পণ্ডিতিয়ার ওই আবাসনের ঠিকানা পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করে রবিবার সকালে শ’দেড়েক লোক সেখানে ঢুকে পার্কিংয়ের ৭৪টি গাড়ি ভাঙচুর করে। তাণ্ডব চলে নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরেও। দুর্ঘটনাটির ব্যাপারে টালিগঞ্জ থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। সোমবার ওই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখাকে। পণ্ডিতিয়া টেরাসের আবাসনে হামলার তদন্ত করছে লেক থানার পুলিশ।
অন্য দিন আবাসনের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে খেলতে দেখা যায় শিশুদের। সোমবার দেখা মেলেনি কারও। ফ্ল্যাট থেকে বেরোতেই দেওয়া হয়নি ওদের। কখন আবার কী হয়, বলা তো যায় না— এমনই অভিমত অভিভাবকদের। আবাসনে ঢুকে গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে রবিবার চার জনের পরে সোমবার আরও সাত জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু তাতেও যে ভরসা ফিরছে না। আবাসনের এক বাসিন্দা প্রমোদ শরাফ বলেন, ‘‘আমরা সিসিটিভি এবং নিরাপত্তারক্ষী বাড়ানোর ব্যাপারেও চিন্তা করছি।’’
বাসিন্দাদের এক জন, নিখিল কোঠারি বলেন, ‘‘ওরা নীচে গা়ড়ি ভাঙচুর করতে করতে উপরে ফ্ল্যাটে উঠে আসারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমরা আটকে দিই।’’ তবে তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, পুলিশ সময় মতো এলে ঘটনাটি এত বড় আকার নিত না। বিপদ কিছুটা হলেও এড়ানো যেত। পুলিশের একটি সূত্রে বলা হয়েছে, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দু’জন পুলিশকর্মীকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটি যে এত বড় আকার নেবে, তা প্রথমেই বোঝার ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যর্থতা ছিল বলে স্বীকার করে নিচ্ছে পুলিশের একাংশ। ঘটনার মাত্রা বুঝে যখন পুলিশের বড় বাহিনী পাঠানো হয় ওই আবাসনে, ততক্ষণে গাড়িগুলি ভাঙা হয়ে গিয়েছে।
এ দিন সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিমা কোম্পানির লোকজন ওই আবাসনে এসেছেন। তাঁরা কথা বলছেন ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িগুলির মালিকদের সঙ্গে। বিমা কোম্পানিগুলি সূত্রে জানানো হয়েছে, গাড়িতে এই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন গাড়ির মালিক। বাসিন্দারা জানান, আবাসনের অধিকাংশ গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে এবং পরপর সেগুলি সারাইয়ের জন্য গ্যারাজ কিংবা ওয়ার্কশপে পাঠানো হচ্ছে। এ দিন যাতায়াত করতে তাঁদের ভরসা ছিল মোবাইল অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি। তবে সেই ব্যাপারেও সতর্ক বাসিন্দারা। অন্য দিন বাড়ির গাড়ি না পেলে ওই আবাসনের অনেক পড়ুয়া নিজেরাই অ্যাপ-ক্যাবে করে স্কুলে চলে যায়। এ দিন দেখা যায়, আতঙ্কিত বাবা-মায়েরা কেউই একা ছাড়তে চাননি তাদের। ছেলেমেয়েদের স্কুলে ছাড়তে গিয়েছেন অভিভাবকেরাই। তাঁদের ভয়, বাইরে বেরোলে যদি আবার কোনও হামলা হয়।
আবাসনের ভিতরে যখন চলছে বাড়তি নিরাপত্তা এবং ক্ষতির হিসেবনিকেশ, বাইরে তখন চলছে অন্য রকম ক্ষোভ-বিক্ষোভ। ধৃত ১১ জনের অধিকাংশই আশপাশের বিভিন্ন বস্তির বাসিন্দা। ওই সব বস্তির মানুষদের দাবি, আসল অভিযুক্তদের না ধরে বস্তির ছেলেদের ধরে অকারণ হেনস্থা করছে পুলিশ। শনিবার গভীর রাতে বিলাসবহুল গাড়ির ধাক্কায় মৃত অভিজিৎ পাণ্ডের দাদা রাহুল পাণ্ডে বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে শ্মশানে যাওয়া এক বন্ধুকেও পুলিশ ভাঙচুরের অভিযোগে তুলে নিয়ে গিয়েছে।’’
মৃতের মা মঞ্জু পাণ্ডের কথায়, ‘‘যে আমার ছেলেটাকে গাড়ি দিয়ে মেরে পালিয়ে গেল, তাকে পুলিশ ধরতে পারল না, অথচ বস্তির নিরীহ ছেলেদের ধরে হাজতে পুরছে।’’
বস্তির লোকজনের দাবি, ওই গভীর রাতে গাড়িটি চালাচ্ছিলেন এক তরুণী। এ ছাড়াও ওই গাড়িতে ছিলেন আরও এক তরুণী ও এক যুবক। ওই গাড়িতে মদের বোতলও পাওয়া গিয়েছে। এই সব তথ্য জানানোর পরেও পুলিশ গাড়ির চালক ও আরোহীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে বস্তির ছেলেদেরই গ্রেফতার করছে বলে অভিযোগ বস্তির বাসিন্দাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy