Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪
পাকড়াও কী ভাবে

ছক কষেই জালে সাম্বিয়া

স্যার আর্থার কন্যান ডয়েল থেকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় থেকে নীহাররঞ্জন গুপ্ত— নিজেদের কিংবদন্তি গোয়েন্দাদের দিয়ে বারবার কথাটা বলিয়ে গিয়েছেন সকলেই। রবিবার সকালে লালবাজারের গোয়েন্দা অফিসারদের কেউ কেউ ওই একই কথা বলছিলেন, ‘অপরাধী সূত্র রেখে যাবেই।’

আদালতে চত্বরে সাম্বিয়া সোহরাব। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

আদালতে চত্বরে সাম্বিয়া সোহরাব। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৫
Share: Save:

অপরাধী যতই ধূর্ত হোক, কিছু না কিছু সূত্র সে রাখবেই।

স্যার আর্থার কন্যান ডয়েল থেকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় থেকে নীহাররঞ্জন গুপ্ত— নিজেদের কিংবদন্তি গোয়েন্দাদের দিয়ে বারবার কথাটা বলিয়ে গিয়েছেন সকলেই। রবিবার সকালে লালবাজারের গোয়েন্দা অফিসারদের কেউ কেউ ওই একই কথা বলছিলেন, ‘অপরাধী সূত্র রেখে যাবেই।’

এবং সাম্বিয়া সোহরাবও দেখালেন, তিনি ব্যতিক্রম নন! তিন দিন আত্মগোপন করে থাকার পর শেষমেশ চতুর্থ দিনে পুলিশের হাতে অজান্তেই মোক্ষম সূত্র তুলে দিলেন তিনি। তা-ও একটি নয়, দু’টি।

এক) শনিবার বিকেলে গোপন ডেরা থেকে সাম্বিয়া ফোন করেন তাঁর স্ত্রীর মোবাইলে। রেড রোডের ঘটনার মাত্র ১২ দিন আগে, ১ জানুয়ারি বিয়ে হয়েছিল তাঁর। তৃণমূল নেতা মহম্মদ সোহরাবের ছোট ছেলে জানতেন না, নববধূর ফোনে আড়ি পেতে সবই শুনছেন গোয়েন্দারা!

দুই) সোহরাব পরিবার অনেকগুলি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে গাড়ি ভাড়া নেয়। সব ক’টির উপরেই নজর রাখছিল পুলিশ। শনিবারই গোয়েন্দারা হঠাৎ জানতে পারেন, ওই দিন ভোরের দিকে সাম্বিয়ার জন্য একটি বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে একটি সংস্থা থেকে। রাতেই তাঁর কলকাতায় ঢোকার কথা!

লালবাজারের একাংশের দাবি, এমন অকাট্য দু’টো প্রমাণ পেতেই জাল বিছোতে শুরু করে পুলিশ। আঠারো জন অফিসার তিন দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েন। একটি দল মোতায়েন থাকে পার্ক সার্কাসে, একটি বিদ্যাসাগর সেতুর টোল গেটে এবং তৃতীয় দলটি যায় উত্তর শহরতলির দিকে। শুরু হয় অপেক্ষা। প্রায় মাঝরাতের কাছাকাছি শ্বশুরবাড়ির পাড়া বালু হক্কর লেনে সাম্বিয়া গাড়ি থেকে নামতেই পার্ক সার্কাসের গোয়েন্দা-দলটি তাঁকে গ্রেফতার করে।

অন্য মতও অবশ্য শোনা যাচ্ছে। লালবাজারেরই একটি সূত্রের দাবি, সোহরাবের ছোট ছেলে আসলে আত্মসমর্পণ করেছেন। এবং এ ক্ষেত্রে মূলত উদ্যোগী হয়েছিলেন শাসক দলের উত্তর কলকাতার এক নেতা এবং গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার। ওই অফিসারই শনিবার কলেজ স্ট্রিটের কাছে এক এলাকা থেকে সাম্বিয়াকে নিজের গাড়িতে তুলে লালবাজারে পৌঁছন বলে সূত্রটির বক্তব্য।

যদিও সেই কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন গোয়েন্দাদের একটা বড় অংশই। তাঁরা বলছেন, সাম্বিয়াকে যে ভাবে দূর থেকে কোণঠাসা করে কলকাতায় ফিরতে বাধ্য করা হল, সেটা পুলিশেরই সাফল্য।

ঘটনার পরে সাম্বিয়া যে প্রথমে কোলাঘাটে গিয়েছিলেন, মোবাইল টাওয়ারের সূত্র ধরে সেই দিনই জানতে পেরেছিল পুলিশ। এর পর শুক্রবার রাতে জানা যায়, সাম্বিয়া আছেন রাঁচিতে। এক অফিসার বলেন, ‘‘আমরা ঠিক করি, সাম্বিয়ার কাছে টাকা পৌঁছনোর ‘সাপ্লাই লাইন’টা কেটে দেব। এ সব ক্ষেত্রে টাকা ফুরোলেই অপরাধী গোপনে ঘরে ফেরার চেষ্টা করে।’’ শনিবারই সাম্বিয়াদের ঘনিষ্ঠ এবং ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সচিন শা নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যাপারটা সচিনই দেখতেন। ফলে টাকায় টান পড়তেই কলকাতায় ফেরার তোড়জোড় শুরু করেন সাম্বিয়া। এর পর নিখুঁত অঙ্ক মেনেই যবনিকা!

শনিবার রাতভর সাম্বিয়াকে জেরা করে গোয়েন্দাদের দাবি, বুধবার ভোরে মদ্যপ অবস্থায় অডি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তিনিই। সেই গাড়িতে পিষ্ট হয়েই মারা যান বায়ুসেনার কর্পোরাল অভিমন্যু গৌড়। এর পর সাম্বিয়া হেস্টিংস মোড় হয়ে নিজের রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে চলে যান। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। পরে বাবা সোহরাবের ফোন পেয়ে সেখান থেকে একটি গাড়ি নিয়ে প্রথমে কোলাঘাট এবং পরে রাঁচি চলে যান। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সাম্বিয়ার দুই সঙ্গী জনি ও শানুও কোলাঘাটে গিয়েছিলেন। তবে তিন জনে একসঙ্গে যাননি।

যদিও জনির পরিবারের দাবি, সে দিন সকালেই জনির এক দাদার বাড়িতে এসে দুর্ঘটনার কথা জানিয়ে জনিকে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সাম্বিয়া। বস্তুত, গোয়েন্দাপ্রধান দেবাশিস বড়াল এ দিনই বলেছেন, সাম্বিয়ার কথায় প্রচুর অসঙ্গতি রয়েছে। জেরায় এক বার তিনি বলেছেন, ঘটনার আগে এক বন্ধুর বাড়িতে তাঁরা কয়েক জন মিলে প্রচুর মদ্যপান করেছিলেন। কিন্তু সেই বন্ধুর বাড়ি ঠিক কোথায়, তা বলতে পারছেন না। আবার জনির পরিবারের বক্তব্য, দইঘাটের এক রেস্তোরাঁয় খানাপিনা করেছিল সাম্বিয়াদের গোটা দল। ফলে ধোঁয়াশা থাকছে। তা ছাড়া, ঘটনার সময়ে অডিতে কে কে ছিলেন, তা নিয়েও সাম্বিয়া অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি।

এ দিন দুপুরে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সাম্বিয়াকে হাজির করানো হয়। আদালতে ছিল ব্যাপক পুলিশি নিরাপত্তা। চারটি থানার অফিসার-পুলিশকর্মীদের নিয়ে হাজির ছিলেন ডিসি সেন্ট্রাল অখিলেশকুমার চতুর্বেদী স্বয়ং। আদালতে সরকারি আইনজীবী বলেন, অভিমন্যুকে পিষে দেওয়ার আগে এক সেনা ক্যাপ্টেনকেও সাম্বিয়ার অডি ধাক্কা মেরেছিল। খুনের অভিযোগের পাশাপাশি খুনের চেষ্টা, সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট ও সরকারি সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগ আনা হয়েছে সাম্বিয়ার বিরুদ্ধে। সাম্বিয়াকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।

সাম্বিয়ার বাবা সোহরাব ও দাদা আম্বিয়া অবশ্য এখনও ফেরার। এক গোয়েন্দা-কর্তা বলেন, ‘‘ওই দু’জনকে ধরাই এখন প্রধান কাজ।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট ছাড়াও অভিযুক্তকে আশ্রয় দেওয়া ও ষড়ষন্ত্রে সামিল থাকার অভিযোগ আনা হবে সোহবার ও আম্বিয়ার বিরুদ্ধে। একই অভিযোগ আনা হবে শানু ও জনির বিরুদ্ধেও।

সেনাবাহিনী জানাচ্ছে, তারা যে সমান্তরাল তদন্ত চালাচ্ছে, সাম্বিয়া গ্রেফতার হলেও তা বন্ধ হবে না। সেনার মুখপাত্র, উইং কম্যান্ডার এস এস বিরদি রবিবার বলেন, ‘‘শুধু গ্রেফতার হলেই তো হবে না। আমরা বিচার চাই। আর তা চাই খুব তাড়াতাড়ি। হতে পারে, আমাদের তদন্তের নথিগুলো ওঁকে সাজা দিতে কাজে লাগবে।’’ তাই পুলিশের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে নজর রাখবে সেনাবাহিনী। নজর রাখা হবে, ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে মোড় নিল।

সেনা অফিসারদের একাংশের দাবি, সাম্বিয়াই যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তার প্রামাণ্য নথি তাঁদের কাছে আছে। পুলিশ যেমন জানিয়েছে, বুধবার ভোরে প্রথম যে কনস্টেবলের সঙ্গে বচসার পরে সাম্বিয়া ব্যারিকেড ভেঙে খিদিরপুর রোডে ঢুকে এসেছিলেন, সেই কনস্টেবল ইতিমধ্যেই ছবি দেখে তাঁকে চিহ্নিত করেছেন।

মেরুন ফুলস্লিভ শার্ট, জ্যাকেট, জিন্‌স, ডিজাইনার চপ্পল পরা সাম্বিয়া এ দিন আদালতে ঢোকার সময়ে সাংবাদিকেরা বারবার প্রশ্ন করেন, তিনি কি আত্মসমর্পণ করলেন?

গাড়িবিলাসী বেপরোয়া তরুণ মুখ ঢেকেছেন কাপড়ে। টুঁ শব্দটি করেননি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kolkata news sambia sohrab red road
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE