অ্যাকাডেমির সামনে প্রতিবাদী জমায়েতে বলছেন সনাতন দিন্দা। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
শেষের দিন নয়, বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভাঙা নিয়ে তৈরি সনাতন দিন্দার ভিডিও বন্ধ করতে পুলিশ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে গিয়েছিল গত শনিবার সন্ধ্যায়, শো-এর প্রথম দিনেই। শুক্রবার আনন্দবাজারের তদন্তে উঠে এল এমনই তথ্য।
যদিও সরকার, পুলিশ, অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষ, সেখানকার তৃণমূল ইউনিয়ন, সনাতন দিন্দার ভিডিওটি চালানোর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি নাকি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শিল্পী নিজে— কে সত্যি বলছেন, কে মিথ্যে, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের ভিডিও-কাণ্ড ঘিরে এখনও সেই ধোঁয়াশা। একে-অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে ভিডিও শো বন্ধ করতে চাওয়ার দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে সব তরফই। এবং পুলিশের তরফে এখনও দাবি, গোলমালের খবর পেয়েই মঙ্গলবার, শেষ দিনে ওই ভিডিও শো বন্ধ করতে গিয়েছিল তারা।
কী ঘটেছিল শনিবার? অ্যাকাডেমির ভিতরে দু’টি গাছের ফাঁকে ঝোলানো ৫৪ ইঞ্চি স্ক্রিনে সনাতন দিন্দার তোলা ভিডিও দেখানো শুরু হয়েছিল সন্ধ্যায়। ভিতরে তখন চলছে ‘হুসেন-১০০’ নামে মকবুল ফিদা হুসেনের শতবর্ষ উপলক্ষে চিত্র-প্রদর্শনী। আচমকাই গেটের ভিতরে ঢুকে সাদা পোশাকের দুই পুলিশকর্মীর প্রশ্ন, ‘এখানে ভিডিও চলছে। আপনারা বন্ধ করছেন না কেন?’
সরাসরি তাঁর দিকে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটায় প্রথমে থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন অনুপ ভাদুড়ী। অ্যাকাডেমির এগজিকিউটিভ কমিটির অন্যতম সদস্য। আগন্তুকেরা অবশ্য তাঁর চেনা মুখ। ‘‘নন্দনে ডিউটি করেন ওই দুই পুলিশকর্মী। আগেও দেখেছি,’’ বলছেন অনুপবাবু। আরও জানাচ্ছেন, প্রথমে অ্যাকাডেমির অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার শুভাশিস ঘোষকে গেটের বাইরে ওই দুই পুলিশকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে দেখেন তিনি। তার পরেই ওই দুই পুলিশকর্মী ভিতরে ঢুকে আসেন। অনুপবাবুর দাবি, তিনি পুলিশকে পাল্টা বলেন, ‘‘আপনারা যদি মনে করেন, তবে বন্ধ করে দিন।’’ এর পরে আর উচ্চবাচ্য না করে ওই দুই পুলিশকর্মী ফিরে যান।
সনাতনের ভিডিও নিয়ে শনিবার, প্রদর্শনীর শুরুর দিনেই যে জলঘোলা হয়েছিল, তা স্বীকার করেছেন অ্যাকাডেমির অছি পরিষদের চেয়ারম্যান, কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ও। মেনে নিয়েছেন ভিডিও বন্ধ করতে বলার কথাও। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে শনিবারই খবর এসেছিল, সেতু ভাঙা নিয়ে ভিডিও দেখানো হচ্ছে। আমি শুনে বলি, ওরা তো ভাড়া নিয়েছে চিত্র প্রদর্শনীর জন্য। সেখানে এ সব কেন দেখানো হবে। আমি বন্ধ করার কথা বলি।’’ তবে, তিনি সরাসরি পুলিশকে ডাকেননি। এমনটাই জানিয়েছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা।
তা হলে কে ডাকল পুলিশ? এই প্রশ্নেই চলছে দায় এড়ানোর খেলা।
যে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের সঙ্গে পুলিশকে কথা বলতে দেখেছিলেন বলে দাবি করেছেন অনুপবাবু, সেই শুভাশিস ঘোষ যেমন আঙুল তুলেছেন অনুপবাবুর দিকেই। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘অনুপবাবুই তো শনিবার বিকেলে ভিডিও শুরুর পরে আমাকে এসে বললেন, ‘দেখেছ! ভিডিও চলছে!’ আমাকে বলা হল, ‘ওদের না বলেছ?’ আমি তখন অ্যাকাডেমির ঢোকার মুখে ডান দিকে ইউনিয়নের ঘরে বসা।’’ শুভাশিসবাবুর বয়ান অনুযায়ী, এর পরে তিনি অনুপবাবুকে বলেন, ‘‘আপনিই ওঁদের বলুন না!’’ যা শুনে অনুপবাবু পাল্টা তাঁকে বলেন, ‘‘ওঁদের বলব, চেয়ারম্যানকেও বলব।’’
শুভাশিসবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তৃণমূল ইউনিয়নের নেতা সন্তোষ দাস। যাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে সবার আগে। বলা হয়েছে, ভিডিও বন্ধ করতে কলকাঠি নেড়েছিলেন তিনিই। আরও অভিযোগ, তিনিই প্রথম পুলিশকে ডেকে আনেন। সেই সন্তোষবাবু এ দিন বলেন, ‘‘আরে, শনিবার রাতে অনুপবাবু তো আমাকেও ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমি ভিডিও-র বিষয়টা পুলিশকে জানিয়েছি। তোকে জানিয়ে রাখছি। পার্থবাবুকে (পার্থ রায়, হুসেন-১০০ প্রদর্শনীর প্রধান উদ্যোক্তা) জানিয়েছি। পার্থবাবু আমাকে বলল, সনাতনকে বলতে। আমি সনাতনকে কিছু বলিনি।’ তবে আমি এর সঙ্গে জড়িত নই।’’
শনিবারের এই ঘটনাক্রমের পরে শান্তিতে কেটেছে রবি ও সোমবার। পুলিশ আসেনি। প্রতিদিন বিকেলের পর থেকে লনে সনাতনের ভিডিও চলেছে। শেষ দিন, মঙ্গলবার বিকেল ৫টা নাগাদ তখন ভিডিও চালানোর তোড়জোড় হচ্ছিল। সন্তোষবাবুর দাবি, তিনি বসেছিলেন গেটের পাশে ইউনিয়নের ঘরে। তাঁর কথায়, ‘‘চার জন পুলিশ অফিসার সোজা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসেন। তখনও ভিডিও চালু হয়নি। ওঁরা এসে দাঁড়িয়ে ভিডিওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বোঝাই যায়, ভিডিও চালু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। মিনিট কয়েকেই ভিডিও শুরু হয়। ওঁরা চার জন এগিয়ে যান ভিডিও-র দিকে।’’
ভিডিও চালাচ্ছিলেন কার্তিক সরকার। কামারহাটির বাসিন্দা কার্তিকের পেশা টিভি-ডিভিডি ভাড়া দেওয়া। তাঁর কথায়, দু’জন ছিলেন পুলিশের পোশাকে। সাদা পোশাকে থাকা বাকি দু’জনের এক জনের কালো প্যান্ট, খয়েরি গেঞ্জি। সাদা গেঞ্জি পরা অন্য জনের মাথায় টাক। কার্তিকবাবুর দাবি, সাদা গেঞ্জির ওই অফিসারই কথা বলেন তাঁর সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘‘ওই অফিসার আমাকে বলেন, ‘ভিডিও বন্ধ করুন। কার অনুমতি নিয়ে চালাচ্ছেন?’ ভয় পেয়ে বলি, ‘আমি জানি না। আমাকে চালাতে বলেছে, তাই চালাচ্ছি।’ তখন মিনিটখানেকও হয়নি ভিডিও শুরু হয়েছে। আমিই ভিডিও বন্ধ করে ভিতরে খবর দিই। তার পরেই তো দাদারা ছুটে আসেন।’’
মঙ্গলবারের ঘটনায় শোরগোলের পরে বৃহস্পতিবার ডিসি (দক্ষিণ) মুরলীধর বলেছিলেন, ‘‘অ্যাকাডেমির মধ্যে দু’পক্ষের গণ্ডগোলের খবর পেয়ে পুলিশ যায়। তার পৌঁছনোর আগেই ভিডিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’’ এ দিনও সেই বক্তব্যেই অনড় তিনি। বলেছেন, ‘‘পুলিশই অনুমতি দিয়েছিল। পুলিশ কেন বন্ধ করবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy