Advertisement
E-Paper

এই থামের ওপর সেতু! শিউরে ওঠেন ইঞ্জিনিয়ার

মাসতিনেক আগের ঘটনা। নীচ দিয়ে যাচ্ছিলেন রেলের এক ইঞ্জিনিয়ার। এই ধরনের ‘স্টিল গার্ডার ব্রিজ’ করার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১০
ভেঙে পড়া উড়ালপুলের ৪০ নম্বর স্তম্ভ। উপরের থামটি-সহ আদতে এটি দেখতে ছিল ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো। সেই ‘টি’-এর মাথা দুমড়ে মুচড়ে এখন উল্টোনো ‘ভি’। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

ভেঙে পড়া উড়ালপুলের ৪০ নম্বর স্তম্ভ। উপরের থামটি-সহ আদতে এটি দেখতে ছিল ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো। সেই ‘টি’-এর মাথা দুমড়ে মুচড়ে এখন উল্টোনো ‘ভি’। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

মাসতিনেক আগের ঘটনা। নীচ দিয়ে যাচ্ছিলেন রেলের এক ইঞ্জিনিয়ার। এই ধরনের ‘স্টিল গার্ডার ব্রিজ’ করার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তাই কৌতূহলের বশেই নজর গিয়েছিল থামগুলোর দিকে। আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলেন তিনি। এত বড় সেতুর জন্য এত দুর্বল স্তম্ভ! সঙ্গে সঙ্গেই এক বন্ধুকে ফোনে ধরেন রেলের ওই ইঞ্জিনিয়ার। সেই বন্ধু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি দফতরের গুরুত্বপর্ণ পদে রয়েছেন। বন্ধুটিকে রেলের ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘‘দোস্ত, ইয়ে ব্রিজ তো গিরনেবালা হ্যায়।’’

আরও পড়ুন: খুনের ধারায় গ্রেফতার নির্মাণ সংস্থার ৩ কর্তা

বন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী তিন মাসের মধ্যে এমন ভাবে মিলে যেতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন রাজ্য সরকারের ওই আমলা-ইঞ্জিনিয়ারটি। তাঁর বিস্ময়, ‘‘ওঁর খালি চোখে ভুলটা ধরা পড়ল, আর কেএমডিএ-র তাবড় ইঞ্জিনিয়াররা তা ধরতে পারলেন না! তা হলে কি ওই উড়ালপুল নির্মাণে কোনও নজরদারিই ছিল না!’’

বিবেকানন্দ উড়ালপুল কেন ভাঙল, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে এ পর্যন্ত। নকশায় গলদ যার অন্যতম। জানা যাচ্ছে, যে সংস্থা কাজটির বরাত পেয়েছিল, ‘কনসালট্যান্ট’ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া ছিল সেই আইভিআরসিএল-রই হাতে। যেটা নিয়মবিরুদ্ধ। খারাপ মালমশলা ও দুর্নীতির অভিযোগ তো রয়েছেই। এর সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে নজরদারিতে গাফিলতির তথ্যও। জানা গিয়েছে, কংক্রিটের স্ল্যাব ঢালাইয়ের সময় নাট-বল্টু খুলে আসতে দেখে শ্রমিকরা যখন কাজ বন্ধ করতে চেয়েছেন, নির্মাণকারী সংস্থার কর্তারা তাতেও কান দেননি। যে কারণে, খুনের মামলাই দায়ের করেছে পুলিশ। আইভিআরসিএল-এর ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে সংস্থাটির ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এই ঘটনায়। শুক্রবার রাতে চাপা পড়া একটি লরি গ্যাস-কাটার দিয়ে কেটে এক জনের দেহ বার করা হয়েছে। তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।

রাজ্য ফরেন্সিক বিভাগের তদন্তকারীরা উড়ালপুল ভাঙার কারণ খুঁজতে গিয়ে এ দিন চিহ্নিত করেছেন কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিট ও রবীন্দ্র সরণির ক্রসিংয়ের একটি স্তম্ভকে। রাস্তার মোড়ে দুমড়ে-মুচড়ে বেঁকে গিয়ে উল্টোনো ‘ভি’ আকার নিয়েছে থামের উপরের অংশ। পিছনেই ঢালু হয়ে রয়েছে উড়ালপুলের ভেঙে যাওয়া অংশ। ফরেন্সিক বিভাগের অফিসার চিত্রাঙ্ক সরকার বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে এই ৪০ নম্বর পিলারটা থেকেই গোলমালের শুরু।’’

কী ভাবে? রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘সেতুর অন্য অংশে দু’‌টো স্তম্ভের মধ্যে দূরত্ব কম। কিন্তু ৪০ এবং ৪১ নম্বরের মধ্যে দূরত্বটা বেশি। কিন্তু তার জন্য ৪০ নম্বর স্তম্ভটি যত শক্তপোক্ত ভাবে তৈরি করার কথা ছিল, মনে হচ্ছে তা হয়নি। তাই ঢালাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্তম্ভের উপরে থাকা বিমটি সরে গিয়েছে। আর তাতেই ভারসাম্য হারিয়ে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে স্তম্ভের উপরে থাকা উড়ালপুলের পুরো অংশটি।’’ রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা জানাচ্ছেন, ৪০ নম্বর স্তম্ভে সেতুর কাঠামো ধরে রাখতে কোনাকুনি ২.৫ মিটারের সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা ছিল মাত্র ১.৫ মিটার। রাজ্য প্রশাসনের ওই শীর্ষকর্তাটি বলেন, ‘‘সেতুর অন্য অংশের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি নেই বলেই মনে হচ্ছে। আপাতত তাই এই উড়ালপুলের অন্য কোনও অংশ ভেঙে পড়ার তেমন আশঙ্কা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবু রাজ্য সরকার আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। রেলের সংস্থা রাইটস-কে সেতুর বাকি অংশ খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।’’

স্থানীয়দের প্রশ্ন, অনেক জায়গাতেই তো কংক্রিটের থামে উড়ালপুল হচ্ছে। এখানে কেন লোহার থাম? এ নিয়ে একাধিক ইঞ্জিনিয়ার ও আমলার বক্তব্য: আগে লোহার থাম দিয়েই সেতু তৈরি হত বেশি। পরে কংক্রিটের থামের চল হয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তা ভেঙে পড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ‘স্টিল গার্ডার ব্রিজ’-এর উপরেই ভরসা করা হয়। এতে কংক্রিটের সেতুটি থাকে লোহার থামের উপরে। বিবেকানন্দ উড়ালপুলে যেটা করা হচ্ছিল।

কিন্তু এর নির্মাণে কেউই যে নিয়মের ধার ধারেনি, সে দিকটিও উঠে এসেছে কেএমডিএ-র অফিসারদের সঙ্গে কলকাতা পুরসভার মেয়র ও কেএমডিএ-র ভাইস চেয়ারম্যানের আলোচনায়। সেই সূত্রেই মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের জানতে পারেন, জেএনএনইউআরএম-এর নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই বছরের পর বছর ধরে উড়ালপুলের কাজ হয়ে চলেছে। নির্দেশিকা অনুযায়ী, একই সংস্থাকে ঠিকাদারির বরাত ও কনসালট্যান্টের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। সে নিয়ম মানা হয়নি বিবেকানন্দ উড়ালপুলের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, যিনি দারোগা, তিনিই অপরাধী। আর এই ভাবে নিয়োগও করেছিল কেএমডিএ-ই। এ

ব্যাপারে মেয়রের বক্তব্য, ‘‘কনসালট্যান্ট নিয়োগ হয়েছে বাম আমলে। সুতরাং অনিয়মের দায় বর্তায় বাম সরকারের উপরেই।’’

কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না, তা খতিয়ে না দেখেই কেন এই প্রকল্পে ফের টাকা ঢালা হল? এর মধ্যে কি কোনও দুর্নীতি রয়েছে?

পুর নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের জবাব, বাম আমলে জেএনএনইউআরএম-এর নিয়ম অনুযায়ী যে ভাবে কাজ হচ্ছিল, সেই ভাবেই কাজ হয়েছে। এর সঙ্গে কিছু যোগও হয়নি, বিয়োগও হয়নি। গুণমানের দিকটি দেখা হয়েছে সেই নিয়মেই। আর দুর্নীতির বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’’

তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, কোন কনসালট্যান্টের ‘নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট’-এর ভিত্তিতে প্রকল্পের কাজ ধাপে ধাপে এগোল?

মেয়র শোভনের জবাব, ‘‘হয় আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে অথবা কেএমডিএ-র সংশ্লিষ্ট কর্তারা বিষয়টি ঠিকমতো জানাননি।’’ অর্থাৎ এই উড়ালপুল নির্মাণে গাফিলতির বিষয়টি কার্যত মেনেই নিয়েছেন শোভন। দুর্ঘটনার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরে দায় যে ক্রমশ কেএমডিএ-র গলায় ফাঁসের মতো চেপে বসছে তা বুঝতে পারছেন নবান্নের কর্তারাও। তাই উড়ালপুল তৈরিতে নজরদারির দায়িত্বে থাকা কেএমডিএ-র এক জন চিফ-ইঞ্জিনিয়ার এবং এক জন এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে শুক্রবার সাসপেন্ড করেছে সরকার। রাজ্যে আর সব সেতু বা উড়ালপুল তৈরির কাজে নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা-ও নিয়মিত তদারকি করে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেএমডিএ এবং পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের।

এ তো সেতু ভাঙার পরে! ২০১৩ সালের ৩ মার্চ উল্টোডাঙায় উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পরেও কেন এ দিকে নজর দেয়নি সরকার? এই প্রশ্নে এ দিন শাসক পক্ষের অস্বস্তি বাড়িয়েছে তৃণমূলেরই এক সাংসদ নেতার মন্তব্য। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেন, ‘‘এলাকার কিছু লোকজন আমাকে জানিয়েছিলেন, নকশায় গোলমাল রয়েছে। সেই কথা জনপ্রতিনিধি হিসেবে সরকারকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু ৬০ শতাংশ কাজ হয়ে যাওয়ায় রাজ্য সরকারের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়নি।’’

উড়ালপুল ভেঙে পড়ার চেয়ে নকশা শুধরে নেওয়াটা ভাল ছিল না?

সুদীপবাবুর জবাব, ‘‘আপনি সেটা মনে করেন। আমি তা মনে করি না।’’ তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘‘আমি মনে করি, রিমডেলিং করা হলে গেলে ভাল হত।’’ তাঁদেরই সরকার কেন তাঁর কথা শুনল না? সুদীপবাবু বলেন, ‘‘আমার সরকার নয়। মা-মাটি-মানুষের সরকার। আমি জনপ্রতিনিধি।’’

২০১৩ সালের ৩ মার্চ উল্টোডাঙা উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পরে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছিলেন, শহরের বাকি উড়ালপুলগুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখবে সরকার। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে প্রশ্ন উঠেছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা হলে সেতু গড়ার নকশা এবং কার্যক্ষেত্রে নির্মাণ কাজে বড়সড় খামতি ছিল কি না, তা ধরা পড়ত। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘সাধারণত যে কোনও সেতুর ঢালাইয়ের কাজ রাতে করা হয়। রাতে শেষ না হলে তা স্থগিত রেখে দেওয়া হয়। ওই দিন কিন্তু রাতে কাজ শেষ হয়নি বলে সকাল থেকে ফের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সময়ে সেতু শেষ করার তাগিদ থেকেই এমন তাড়াহুড়ো হয়।’’ দিনের বেলা কেন কাজ হচ্ছে, তা নিয়ে কেন কেএমডিএ-র ভারপ্রাপ্ত কর্তারা কোনও প্রশ্ন তোলেননি, উঠেছে সেই প্রশ্নও।

কেএমডিএ অবশ্য যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছে নির্মাণ সংস্থা আইভিআরসিএল-এর উপরেই। ওই সংস্থার পক্ষ থেকে অবশ্য অনিয়মের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খারিজ করে দেওয়া হয়েছে খারাপ মানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগও। সংস্থার আইনি পরামর্শদাতা পি সীতা এ দিন বলেন, ‘‘জিনিসপত্রের মান নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। উড়ালপুলের সব অংশে একই মানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে।’’

আইভিআরসিএল-ও ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চায় বলে জানিয়ে সীতা বলেন, ‘‘আমরাও জানি না, কী ভাবে এমন একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল। আমরাও এর কারণ জানতে চাই। আমরা তদন্তের কাজে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত।’’ সীতা জানান, সেতু তৈরির কাজে দেরির দায় শুধু ঠিকাদারদেরই নয়। তবে তাঁরা কারও দিকে আঙুলও তুলছেন না।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy