Advertisement
১১ মে ২০২৪

আর বঞ্চনা নয়, আলোর পথে পঞ্চম অবতারেরা

পুরাণ মতে, বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার অর্থাৎ বামনাবতার ওঁরা। প্রতি শীতে শহরের বিভিন্ন সার্কাসের তাঁবুতে ওঁদের দেখা মিলত জোকার সাজে।

সাজব যতনে: সার্কাসে নামার আগে তুলির টান। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

সাজব যতনে: সার্কাসে নামার আগে তুলির টান। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৬
Share: Save:

শীতের শহর থেকে ওঁরা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন!

পুরাণ মতে, বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার অর্থাৎ বামনাবতার ওঁরা। প্রতি শীতে শহরের বিভিন্ন সার্কাসের তাঁবুতে ওঁদের দেখা মিলত জোকার সাজে। জীব-জন্তুর পাশাপাশি তাঁদের খেলা দেখে হেসে লুটোপুটি খেত আট থেকে আশি। নিয়মের বেড়াজালে আটকে জীবজন্তুর খেলা নিষিদ্ধ হতেই জৌলুস হারিয়েছে প্রখ্যাত সার্কাস দলগুলি। জাগলিং, ব্যালান্সের খেলার পাশাপাশি মনোরঞ্জনের শেষ ভরসা ছিল ওঁদের রঙ্গরস।

সার্কাসের তাঁবুতে বামনদের সংখ্যা এখন হাতে গোনা। বহু বছর ধরে সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘আগে ১০-১২ জন করে বামন থাকতেন। এখন মেরেকেটে ২-৩ জন থাকেন। ওঁরা না থাকলে সার্কাস দেখতে আসা দর্শকদের হাসাবেন কারা!’’

এক সময়ে শহর যাঁদের দেখত শুধুই হাসির খোরাক হিসেবে, এখন পরিবর্তন এসেছে সেখানেই। ওঁদের চেনা শহরটা এখন ‘অন্য শহর’। যেখানে তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন বেঁচে থাকার অন্য পথ। পথচলতি আগন্তুক থেকে প্রতিবেশীরাও এখন তাঁদের দেখে হাস্যকর মন্তব্য ছুড়ে দিতে সঙ্কোচ বোধ করেন। চার বছর আগে বামনদের নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘ছোটদের ছবি’-র পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের উপলব্ধি, ‘‘শহরের মানসিকতা এখন বদলেছে। মানুষ এখন মনে করেন, উপহাস করলে আমি ছোট হচ্ছি, ওঁরা নয়।’’

কৌশিকবাবুর সঙ্গে একমত সিঁথি ময়দানে চলা সার্কাসের ম্যানেজার খন্দকর আবু সলমনও। তিনি বলেন, ‘‘বামনেরাও এখন বুঝেছেন, তাঁরা শুধু হাসির পাত্র নন। আর মানুষও সেই চোখে ওঁদের না দেখে অন্য কাজের সুযোগ দিচ্ছেন।’’ কিন্তু বামনদের অভাবে সার্কাস যে খানিকটা জৌলুসহীন হচ্ছে, তা মেনে নিয়ে তিনি জানান, এক সময়ে রুজির টানে গ্রাম থেকে শহরে আসা বামনেরা যোগ দিতেন সার্কাসে। নিজেদের শারীরিক গঠনের সঙ্গে রঙ্গরসের কৌশল রপ্ত করে মজিয়ে রাখতেন দর্শকদের। সেই ‘রুচি’ এখন বদলেছে বলেই দাবি ত্রিশ বছরেরও বেশি সার্কাসের ব্যবসায় যুক্ত মানুষটির।

তিনি জানান, জীবজন্তুর খেলা বন্ধ হওয়ার পর থেকে শহরের সার্কাসে ভাটার টান। দর্শক কম হওয়ায় আয়ও কমছে। এক জন বামন জোকার সেজে মাসে ১২-২০ হাজার টাকা রোজগার করেন। কিন্তু সারা বছর পরিবার ছেড়ে গোটা দেশ ঘোরা এবং একটানা ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে নারাজ ওঁরা। কারণ, ওঁদের কাছে এসে গিয়েছে বিকল্প কাজের সুযোগ। পেট্রোল পাম্পে তেল ভরা, পার্কিং লটের কর্মী, অফিসে পিওন, সোনা এবং জেরক্সের দোকান-সহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছেন ওঁরা। অনেকে আবার দ্রুত বেশি রোজগারের আশায় কোনও অনুষ্ঠানে মডেল সাজছেন। রাজ্য সরকারের তরফেও বামনেরা এখন প্রতিবন্ধীদের সুবিধা পান।

কৌশিকবাবুর সিনেমার মুখ্য অভিনেতা দুলাল সরকার বলেন, ‘‘আমরা আগে অন্ধকারে ছিলাম। এখন আলোর পথ দেখেছি। প্রমাণ করতে পেরেছি শুধু সার্কাস নয়, আমরাও সব কাজ করতে পারি। একটা জায়গায় বাঁধা থাকতে কারই বা ভাল লাগে!’’ সিঁথির সার্কাসের তাঁবুর পিছনে মেকআপ রুমে বসে মুখে রং করার মধ্যেই রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘‘অন্য কাজ করলে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো যায়। আমরা কয়েক জন অবশ্য এই কাজটাকে ভালবেসে আজও রয়ে গিয়েছি।’’ তিনি জানান, তাঁদের সার্কাসে এক সময়ে ৬-৭ জন বামন থাকতেন। এখন সেখানে শুধুই রফিকুল ও তাঁর ছেলে করিম শেখ।

একটা সময় ছিল যখন বহু সিনেমায় জন্মদিন কিংবা অন্য কোনও দৃশ্যে ডিগবাজি খেয়ে, লাফিয়ে কোলে উঠতে দেখা যেত বামনদের। কৌশিকবাবুর কথায়, ‘‘যুগ যুগ ধরে কিছু মানুষের শারীরিক অক্ষমতা দেখে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত দর্শক মজা পেতেন। এ সব বন্ধ করার লক্ষ্যেই সিনেমাটা বানাই।’’ নিজেকে প্রমাণ করেছেন হাওড়ার দুলাল। এক সময়ে বন্ধু ও পড়শিদের কটূক্তির জেরে স্কুল যাওয়া বন্ধ করা সেই বামনের ঝুলিতে এখন জাতীয় অভিনেতার পুরস্কার। সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা মিলছে তাঁর মতো অনেকের।

একটা সময়ে সমাজের সব সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত থাকতেন বামনেরা। বছর কুড়ি আগেও খাস কলকাতার কিছু তথাকথিত শিক্ষিত পরিবার বামনদের অশুভ মনে করে বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাত না। তারই যেন প্রতিফলন ঘটেছিল ‘ছোটদের ছবি’-র একটি দৃশ্যে। যেখানে মুখ্য মহিলা বামন অভিনেত্রী তাঁর বাবার শ্রাদ্ধে প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ না করা প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমাদের তো পাড়ার কোনও বিয়েবাড়ি বা অনুষ্ঠানে ডাকে না। আমরা যদি অশুভ-ই হই, তা হলে আমাদের সবই অশুভ হোক।’’

যদিও করিম, দুলালেরা বলছেন, শুভ চেতনায় জেগে ওঠা শহরটা এখন তাঁদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Circus Joker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE