Advertisement
০৮ মে ২০২৪
উত্তর দমদম

লাল ‘গড়ে’ সবুজ নিশান উড়বে কি, অপেক্ষায় এলাকা

৩৪ বছর পরে রাজ্যে বাম জমানার অবসান হয়ে ক্ষমতা বদল হয়েছে। তবে শাসন-ক্ষমতা বদলালেও উত্তর দমদম পুরসভায় গত ৪০ ধরে রয়েছে বাম পরিচালিত পুরবোর্ড। এমনকী, গত পুর-নির্বাচনে যখন এক এক করে শহরতলির প্রায় সব পুরসভাই তৃণমূল দখলে এনেছিল, তখনও বামেদের দখলে ছিল একমাত্র উত্তর দমদম পুরসভাই। এ বার তাই ভোটের আগে প্রধান প্রশ্ন, তৃণমূল কি পারবে এই পুরসভায় ৪০ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটাতে?

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫২
Share: Save:

৩৪ বছর পরে রাজ্যে বাম জমানার অবসান হয়ে ক্ষমতা বদল হয়েছে। তবে শাসন-ক্ষমতা বদলালেও উত্তর দমদম পুরসভায় গত ৪০ ধরে রয়েছে বাম পরিচালিত পুরবোর্ড। এমনকী, গত পুর-নির্বাচনে যখন এক এক করে শহরতলির প্রায় সব পুরসভাই তৃণমূল দখলে এনেছিল, তখনও বামেদের দখলে ছিল একমাত্র উত্তর দমদম পুরসভাই। এ বার তাই ভোটের আগে প্রধান প্রশ্ন, তৃণমূল কি পারবে এই পুরসভায় ৪০ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটাতে?

তৃণমূলের হয়ে উত্তর দমদমে প্রচারে এসে সাংসদ সৌগত রায় বলছেন, ‘‘এই পুরসভা এলাকায় পরিষেবার যা হাল, তাতে মানুষ বদল চান। এ বার ৪০ বছরের বাম পুরবোর্ডের অবসান হবেই।’’ উত্তর দমদমের সিপিএম চেয়ারম্যান তথা বিরাটি মোড় এলাকার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী সুনীল চক্রবর্তী তার জবাবে বলছেন,‘‘এই পুরসভায় মানুষ শান্তিতে বাস করছেন। কোনও সন্ত্রাস নেই। তাঁরা খামোখা বদল চাইবেন কেন? এ বারও আমরাই বোর্ড গড়ব।’’

গত পুর নির্বাচনে উত্তর দমদমে ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে বামেরা পেয়েছিল ১৭টি। তৃণমূলের দখলে এসেছিল ১২টি এবং কংগ্রেস ২টি। তবে গত বার ৩১টি ওয়ার্ডে ভোট হলেও এ বার উত্তর দমদমে মোট ওয়ার্ড ৩৪। কয়েকটি ওয়ার্ড খুব বড় হয়ে যাওয়ায় সেগুলি ভেঙে আরও তিনটি ওয়ার্ড বাড়ানো হয়েছে। গত পুরভোটে এখানে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে জোট হয়েছিল। সে বার বামেরা ১৭টি আসন পেলেও পরিবর্তন যে উত্তর দমদমেও হচ্ছে, তা টের পাওয়া গিয়েছিল গত লোকসভা নির্বাচন থেকেই। সেই বিচারে দেখা যাচ্ছে, ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে অধিকাংশ ওয়ার্ডেই এখন এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।

অন্য দিকে, গত বারের লোকসভা ভোটে মোদি-হাওয়ার মধ্যেও উত্তর দমদম পুরসভায় সে ভাবে দাঁতই ফোটাতে পারেনি বিজেপি। দমদম বা দক্ষিণ দমদম পুরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে এগিয়ে থাকলেও উত্তর দমদমে তারা কিন্তু কোনও ওয়ার্ডেই প্রথম হতে পারেনি।

এ বার অবশ্য ৩৪টি ওয়ার্ডে প্রার্থীই দিতে পারেনি বিজেপি। তারা প্রার্থী দিতে পেরেছে ২৬টি ওয়ার্ডে। কেন সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারল না বিজেপি? উত্তর দমদমে বিজেপি-র সংগঠকদের অভিযোগ, ৬টি ওয়ার্ডে তৃণমূলের নেতাদের হুমকির ভয়ে দিতে তারা প্রার্থী দিতে পারেনি। আর দু’টি ওয়ার্ডে দেওয়া যায়নি কিছু ভুলভ্রান্তির জন্য। যদিও হুমকির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের বক্তব্য, উত্তর দমদমে বিজেপি-র সংগঠন এতই দুর্বল যে তারা এখন হুমকির অজুহাত দিচ্ছে। এই পুরসভা এলাকা মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি অধ্যুষিত। অবাঙালির সংখ্যা কার্যত হাতেগোনা। ফলে দমদম বা দক্ষিণ দমদমের মতো এই পুর-এলাকায় বিজেপি-র নিজস্ব ভোটার কত, সেই প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী প্রবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ভোটের দিন বেলা ১২টা পর্যন্ত অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হলে আমরা কয়েকটি ওয়ার্ডে জিতছিই।’’

এই প্রেক্ষিতে উত্তর দমদম পুরসভায় লড়াইটা মূলত তৃণমূল বনাম বামফ্রন্ট বলেই মনে করছেন অনেকে। শুধু বিজেপিই নয়, কংগ্রেসও এই পুরসভায় সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারেনি। ৩৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তারা প্রার্থী দিয়েছে ২৪টি ওয়ার্ডে। গত পুরভোটে কংগ্রেসের বরাতে জুটেছিল মাত্র দু’টি আসন। তার উপরে মাসখানেক আগে এলাকায় কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ও বাম পুরবোর্ডের বিরোধী দলনেতা সুবোধ চক্রবর্তী যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। অনেকের মতে, এর ফলে উত্তর দমদমে কংগ্রেস সাংগঠনিক ভাবে আরও দুর্বল হয়ে যাবে। এলাকার এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘সুবোধদা এলাকার বর্ষীয়ান নেতা। উনি আমাদের দলে যোগ দেওয়ায় এ বার আমরা আরও শক্তিশালী।’’ সুবোধবাবু এ বার তাঁর নিজের ওয়ার্ড ১৯ নম্বর থেকেই তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন। কংগ্রেসের হয়ে সুবোধবাবুর জায়গায় এ বার দাঁড়িয়েছেন সমীর সেন। জেলা কংগ্রেস সভাপতি (শহর) তাপস মজুমদার বলেন, ‘‘সুবোধদার তৃণমূলে চলে যাওয়াটা এলাকার কংগ্রেস ভোটাররা ভাল ভাবে নেননি। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে আমরাই জিতব। উত্তর দমদমের আরও কয়েকটি ওয়ার্ডেও ভল ফল হবে।’’

উত্তর দমদম পুরসভার বর্তমান চেয়ারম্যান সুনীল চক্রবর্তী জানান, এ বার ৩১টি ওয়ার্ড ভেঙে ৩৪টি করা হয়েছে। সুনীলবাবুর দাবি, এর ফলে ওই ওয়ার্ডগুলিতে পুর পরিষেবা আরও ভাল হবে। যদিও বিরোধীরা জানাচ্ছেন, পুর পরিষেবার এই বেহাল অবস্থায় আর ওয়ার্ড বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। বরং বামেরা যদি মনে করে ওয়ার্ড বাড়িয়ে আগের মতো আরও আসন বাড়াতে পারবে, তা হলে সে গুড়ে বালি।

দমদমে কিছু পঞ্চায়েত এলাকাকে পুরসভার মধ্যে ঢুকিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল বামেরা। একই ঘটনা উত্তর দমদমেও। সুলতানপুরের এক ও দু’নম্বর পঞ্চায়েত এবং বিশরপাড়াকে সংযোজিত এলাকা করে তারা উত্তর দমদম পুরসভার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। ফলে সেই ওয়ার্ডগুলি তারা দখলেও রাখতে পেরেছিল পরবর্তী কালে। কিন্তু ওই পঞ্চায়েত এলাকা পুরসভার মধ্যে এলেও সেখানে পুর-পরিষেবার কোনও উন্নতি হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। তাদের দাবি, ওই সব এলাকার আদৌ কোনও উন্নতি হয়নি। বামেরা শুধু নিজেদের ভোট বাড়িয়েছে।

গত পুরভোটেই অবশ্য ওই সংযোজিত এলাকাগুলির কিছু ওয়ার্ড দখলে এনেছিল তৃণমূল। এ বারও তৃণমূল প্রার্থী সৌমেন রায় দাবি করছেন, পরিষেবার যা হাল, তাতে এ বারও তাঁরা বাম-ঘাঁটির সব ওয়ার্ড দখল করবেন।

তাই এ বার প্রার্থীরা মূলত ভোট চাইছেন পরিষেবা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই। যদিও বিরোধীদের এই যুক্তি মানতে রাজি নয় বামেরা। তাদের মতে, পুর পরিষেবার কী উন্নতি হয়েছে, তা ওয়ার্ডগুলি ঘুরলেই স্পষ্ট হবে। বাম নেতাদের কথায়, কেন্দ্রীয় সরকার ও কেএমডিএ-র পানীয় জলপ্রকল্প খুব ধীর গতিতে চলছে। তাঁরা নিজেদের উদ্যোগেই বহু ওয়ার্ডে পানীয় জল পৌঁছে দিয়েছেন। এমনকী, উত্তর দমদমে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল জল জমা। সেই সমস্যা অধিকাংশ ওয়ার্ডেই আর নেই। খালগুলির সঙ্গে নিকাশি নালা যোগ করে দেওয়ায় জমা জল দ্রুত খালে গিয়ে পড়ছে। পাশাপাশি, উত্তর দমদম পৌর হাসপাতালের পরিষেবাও গত পাঁচ বছরে যথেষ্ট উন্নত হয়েছে।

বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, এই পুর-পরিষেবার সুফল পাচ্ছে মাত্র কয়েকটি ওয়ার্ড। বিরাটি স্টেশন সংলগ্ন পাঠানপুর, মহাজাতি নগর, যশোহর রোড সংলগ্ন বিরাটি মোড় এলাকাতেই পরিষেবার হাল কিছুটা ফিরেছে। কিন্তু বাকি বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা উন্নত পরিষেবার ছিটেফোঁটাও পাননি। সেই সব এলাকার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের রাস্তা এখনও কাঁচা, নিকাশি ব্যবস্থা ভাল নয়, এমনকী কিছু কিছু ওয়ার্ডে প্রায় সারা বছরই জমা জল পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। আরও অভিযোগ, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে সংলগ্ন উত্তর দমদমের বেশ কিছু এলাকার রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো না থাকায় এক্সপ্রেসওয়ে অন্ধকার থাকে। ফলে বহুতল আবাসন সংলগ্ন এক্সপ্রেসওয়েতে লেগেই থাকে ছোটখাটো দুর্ঘটনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE