পাড়ায় তারস্বরে মাইকে গান বাজছে। শব্দের দাপটে অতিষ্ঠ লোকজন। সেই উপদ্রবের প্রতিবাদ করেন কসবা এলাকার শরৎ ঘোষ গার্ডেন রোডের এক তরুণী। অভিযোগ, সেই প্রতিবাদের জন্য তাঁকে ‘নিগৃহীত’ হতে হয়েছে।
ছবিটা অবশ্য তার পরেও বদলায়নি। শনিবার রাত এগারোটাতেও কসবার রথতলা এলাকায় তীব্র স্বরে বেজেছে মাইক। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় শেষমেশ লালবাজার কন্ট্রোলে ফোন করে অভিযোগ জানিয়েছেন কয়েক জন বাসিন্দা।
শুধু কসবাই নয়, সরস্বতী পুজো উপলক্ষে সারা শহর জুড়েই এ বার ছিল শব্দের অত্যাচার। বিসর্জনের শোভাযাত্রাতেও শব্দদানবের দাপটে অতিষ্ঠ হয়েছেন লোকজন। পুলিশের কাছে অভিযোগও জমা পড়েছে বিস্তর। বহু ক্ষেত্রে কটূক্তি বা পরোক্ষে হুমকিও মিলেছে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে।
দুর্গাপুজো বা কালীপুজোয় শব্দদানবের দাপটে অতিষ্ঠ হওয়া নতুন নয়। কিন্তু বাগ্দেবীর আরাধনায় এমন উৎপাত আগে দেখা যায়নি বলেই মানুষজনের অভিযোগ। তাঁরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে সরস্বতী পুজোর চেহারা বদলাচ্ছে। অলিগলির পুজো বহরে যেমন বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে জৌলুসও। জুড়ছে ডিজে, মাইকের দাপটও। কিন্তু দুর্গাপুজো, কালীপুজোয় পুলিশ ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের যেটুকু সক্রিয়তা চোখে পড়ে, সরস্বতী পুজোয় তার ছিটেফোঁটাও নজরে আসেনি বলে অভিযোগ।
সরস্বতী পুজোয় নয়া এই উপদ্রবের কথা একান্তে মানছেন পুলিশের একাংশও। ওসিদের অনেকেই বলছেন, বাগ্দেবীর পুজো বা বিসর্জনের যা চেহারা নজরে এসেছে, তাতে তাজ্জব বনে গিয়েছেন তাঁরাও। থানার এক অফিসারের কথায়, ‘‘এ বার অভিযোগ পেতে পেতে পাগল হয়ে গিয়েছি।’’
প্রশ্ন উঠেছে, এমন উপদ্রব রুখতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বা পুলিশের সক্রিয়তা দেখা গেল না কেন? পর্ষদ সূত্রের খবর, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, বর্ষবরণের মতো সব উৎসবেই শব্দ দূষণ রোধের নির্দেশিকা পুলিশ-প্রশাসনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শব্দ আইন ভাঙলে কী শাস্তি হওয়া উচিত, তা স্পষ্ট করে নির্দেশিকায় বলে দেওয়া থাকে। কিন্তু একমাত্র কালীপুজোর ক্ষেত্রেই পর্ষদের কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। পর্ষদের অফিসারদের দলও থাকে রাস্তায়। কিন্তু বাকি কোনও উৎসবেই সেই ব্যবস্থা থাকে না।
কেন থাকবে না সেই ব্যবস্থা? পরিবেশ দফতরের এক পদস্থ কর্তা সাফ জানাচ্ছেন, সব উৎসবে কন্ট্রোল রুম খুলে বা দল নামিয়ে শব্দদানবের মোকাবিলা করার মতো পরিকাঠামো পর্ষদের নেই। ফলে এ ক্ষেত্রে পুলিশের উপরেই নির্ভর করতে হয়। পুলিশের এক কর্তাও বলছেন, ‘‘কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। ফলে সরস্বতী পুজোয় আলাদা করে কন্ট্রোল রুম খোলার প্রশ্ন নেই। তবে এটা ঠিক, মাইকের দাপট যে ভাবে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে এখানেও কড়া পদক্ষেপ করা হবে।’’ তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ নিয়ে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
শব্দ-দৈত্যের অত্যাচার সম্পর্কে কী বলছে পুলিশ?
লালবাজার জানিয়েছে, অভিযোগ মিললে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানা থেকে পুলিশকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। মাইক, ডিজে বন্ধও করা হয়েছে। কিন্তু প্রায় সব ঘটনাতেই অভিযুক্তেরা নাবালক হওয়ায় গ্রেফতার করা হয়নি। কখনও বুঝিয়ে, কখনও বা ধমকে নিরস্ত করা হয়েছে তাদের। কসবার ঘটনাতেও যেমন অভিযুক্ত নাবালক হওয়ায় গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশের এক কর্তা জানান, সাত বছরের কম সাজা এমন অপরাধের ক্ষেত্রে নাবালকদের গ্রেফতার করা যায় না। কসবার মতো ঘটনা ঘটলে অবশ্য সংশ্লিষ্ট নাবালক অভিযুক্তকে জুভেনাইল কোর্টে নিয়ে গিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
পরিবেশকর্মীদের অনেকে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, কালীপুজো, দুর্গাপুজোর আগে শব্দ দূষণ নিয়ে সচেতনতা প্রসারে নামে পুলিশ-পর্ষদ। তাতে কিছুটা হলেও ফল পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে সরস্বতী পুজোর আগে কেন এ নিয়ে সচেতনতা প্রসার করা হবে না? পুলিশের একাংশও বলছে, দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোয় প্রশাসনের অনুমতি লাগে। ফলে পুজোর আগে সমন্বয় সভাগুলিতে শব্দ দূষণ নিয়ে উদ্যোক্তাদের সাবধান করে দেওয়া হয়।
ফি বছর অলিগলিতে সরস্বতী পুজো শুরু হলেও প্রতিমা, মণ্ডপ ছোট হওয়ার ফলে আইনি অনুমতি বা সমন্বয় সভার ব্যবস্থা নেই। ফলে কে কোথায় পুজো করছে, তার নির্দিষ্ট তথ্য থানাগুলিতে থাকে না। তাই সাবধান করারও পথ থাকে না। ‘‘সরস্বতী পুজো আকারে ছোট বলে পুলিশ-প্রশাসনের নজরে আসে না। কিন্তু শব্দের দাপটে নাগরিকদের কান ঝালাপালা হচ্ছে’’— মন্তব্য এক পরিবেশকর্মীর।
এই শব্দের গুঁতো প্রশাসনের কানে কবে পৌঁছয়, সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy