Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘আজ তো দাদা নেহি পিটেগা’, তেরঙা হাতে হাসছে বাবলুরা

সবই পতাকা। আর এই পতাকার মাহাত্ম্য এই দিনটায় দিব্য টের পায় সিগন্যাল-শিশুর দল। ‘‘প্রায় সব গাড়িতেই লাগায় তো। জোড়ায় বিক্রি করি। দশ থেকে তিরিশ, নানা রকম দাম। আজ সব বিক্রি হলে ভাল, নইলে কালও হবে। তা-ও না হলে পরের বছরের জন্য তুলে রাখা যায়।’’— স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন, সোমবার বিকেলে রাসবিহারী মোড়ের সিগন্যালে ব্যস্ত হাতে পতাকা বেচতে বেচতে বলল বারো বছরের আরিফ।

আজাদি: ট্র্যাফিক সিগন্যালে বিকিকিনি। সোমবার, ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র

আজাদি: ট্র্যাফিক সিগন্যালে বিকিকিনি। সোমবার, ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৭ ০৩:৫০
Share: Save:

এই দিনটা আরিফকে মার খেতে হয় না বাবার কাছে। সারা দিনের পরে যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, বিক্রির পরিমাণ দেখে বাবার মনমেজাজ খুশ হয়ে যায়।

এই দিনটার শেষে ভাত একটু বেশি করা হয়। বাবলুকে খিদে নিয়ে ঘুমোতে হয় না। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি রোজগার হয় যে তার!

এই দিনটায় ঠান্ডা গাড়ির কাচের ও পার থেকে মুখ ঝামটা ছুটে আসে না মৌসমের দিকে। প্রতি দিন যাঁরা বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে চলে যান, তাঁরাই এ দিন কাচ নামিয়ে দরাদরি করেন।

এই ঘটনাগুলোই ওদের কাছে আর পাঁচটা দিনের চেয়ে আলাদা করে তোলে বছরের এই বিশেষ দিনটিকে। করে তোলে একটু আনন্দের, একটু স্বস্তির, একটু স্বাচ্ছন্দ্যের ১৫ অগস্ট।

স্বাধীনতার দিন, গর্বের দিন, সম্মানের দিন, আনন্দের দিন। সারা দেশের মানুষের কাছে উদ্‌যাপনের দিন। ওদের কাছেও তাই।

ওরা পথশিশু। রাস্তার ধারে, ফুটপাথের উপর, ত্রিপলের আড়ালে ওদের ঘুম ভাঙে রোজ। বাবা-মা-কাকা-দাদাদের কাছে হিসেব বুঝে নিয়ে ট্র্যাফিক সিগন্যালে সিগন্যালে বেরিয়ে পড়া। এক এক জনের এক এক জায়গায় ‘কাজ’।

কোনও দিন হাতে ধরা লাল-হলুদ-সাদা গোলাপের ঝাঁক, কোনও দিন আবার প্যাকেটবন্দি স্ট্রবেরি। কোনও দিন বা ধূপকাঠি। বেচতে হবে। রীতিমতো হুমকি থাকে, দিনে কতটা বিক্রি করে ঘরে ফিরবে তারা। কোনও দিন বা বিক্রিবাটা নয়, শুধুই ভিক্ষা। ভিক্ষার দিনগুলোয় কখনও আবার খুদে কোলে একটা করে আরও খুদে ছানা গুঁজে দেয় বড়রা। টাকা বেশি মেলে তাতে। এই দিনগুলোতেও ঠিক করে দেওয়া থাকে ন্যূনতম ভিক্ষার মাপকাঠি। যা ছুঁতে না-পারলেই ঘরে ফিরে শাস্তি। আর বলাই বাহুল্য, সেই শাস্তির বেড়া পার করে ফেলতে পারার মতো রোজগার খুব কম দিনই করতে পারে ওরা।

আরও পড়ুন:শেষলগ্নে মোদী-মেল

তবে এই দিনটা অবশ্য আলাদা। ফুল-ফল-ধূপ-শিশু নয়, হাতে থাকে গোছা গোছা জাতীয় পতাকা। নানা কিসিমের। ছোট ছোট কাঠিতে মোড়া তেরঙা কাগজ, বা বেলুনের মতো ফোলানো পতাকার চেহারা, বা কোণাকুনি করে গাঁথা ছোট্ট দু’খানি পতাকার ধাতব প্রতিকৃতি।

সবই পতাকা। আর এই পতাকার মাহাত্ম্য এই দিনটায় দিব্য টের পায় সিগন্যাল-শিশুর দল। ‘‘প্রায় সব গাড়িতেই লাগায় তো। জোড়ায় বিক্রি করি। দশ থেকে তিরিশ, নানা রকম দাম। আজ সব বিক্রি হলে ভাল, নইলে কালও হবে। তা-ও না হলে পরের বছরের জন্য তুলে রাখা যায়।’’— স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন, সোমবার বিকেলে রাসবিহারী মোড়ের সিগন্যালে ব্যস্ত হাতে পতাকা বেচতে বেচতে বলল বারো বছরের আরিফ। উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসা বাবলুর হাত তখন খালি, মুখে হাসি। আরিফের থেকে কিছু পতাকা হিসেব করে বুঝে নিয়ে বলে, ‘‘আজ তো দাদা নেহি পিটেগা। সব বেচ দিয়া।’’

ধর্মতলা মোড়ের বছর দশেকের কিশোরী মৌসমের আবার সব চেয়ে খারাপ লাগে, কেউ কোনও কথাই শুনতে চায় না। ভাইয়ের অসুখ, বাবার মৃত্যু— কিছুই নয়। বছরের বাকি ৩৬৪ দিন তো এমনটাই যায়। অবহেলায়, বিরক্তিতে, অবিশ্বাসে। মুখের উপর সপাটে উঠে যায় গাড়ির কাচ। কিন্তু এই দিনটা আলাদা। গাড়ি থামে। কাচের এ পার থেকে আকুতি করার আগেই ও পার থেকে বেরিয়ে আসে দশ টাকার নোট-সহ হাত। ক্রেতা খুশি, খুশি মৌসমও। হাসি মুখে এগিয়ে দেয় পছন্দের তেরঙা।

আর এ ভাবেই ঘিঞ্জি শহরের ট্র্যাফিক সিগন্যালগুলোয়, সবার অলক্ষ্যে ডানা মেলে কিছু অন্য স্বাধীনতা। মাঠ-ময়দান, বিশাল বিল্ডিং বা গম্ভীর প্রতিষ্ঠানে ওড়া উঁচু পতাকাগুলির পাশে পাশেই খিলখিল করে অজস্র ছোট ছোট তেরঙাও। হোক কাগজ-প্লাস্টিক দিয়ে বানানো, হোক এক দিনের জন্য। তবু, তারাও প্রতিনিধিত্ব করে স্বাধীনতারই।

যে স্বাধীনতার অর্থ কতগুলো খুদে মুখের সামনে এক বেলার ভরপেট খাবার বা অন্য দিনের তুলনায় কয়েক ঘা মার কম খাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE