Advertisement
E-Paper

সিন্ডিকেটে রক্ষা নেই, জরিমানার বিষফোড়া

প্রায় কোটি টাকা দিয়ে কেনা আধ একর জমির উপরে এত দিনে ছ’তলা বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। রয়্যাল ব্যাঙ্ক অব স্কটল্যান্ড, বার্কলেজ, ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার মতো প্রথম সারির ব্যাঙ্কগুলির কাজ নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকার কথা ৪০০ অ্যানালিস্টের। কিন্তু জমি নেওয়ার সাত বছর পরে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা লগ্নি করেও অফিস চালু করে উঠতে পারেননি কলকাতায় ছোটবেলা কাটিয়ে ইংল্যান্ডে থিতু হওয়া এক ব্যবসায়ী। সিন্ডিকেটের দাপট আর হিডকো-র আইনি চোখরাঙানিতে নিজের শিকড়ে ফেরার স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয় তাঁর। জোড়া চাপে এতটাই সন্ত্রস্ত তিনি, যে নিজের বা সংস্থার নামটুকু পর্যন্ত প্রকাশ্যে আনতে রাজি নন।

গার্গী গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২১

প্রায় কোটি টাকা দিয়ে কেনা আধ একর জমির উপরে এত দিনে ছ’তলা বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। রয়্যাল ব্যাঙ্ক অব স্কটল্যান্ড, বার্কলেজ, ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার মতো প্রথম সারির ব্যাঙ্কগুলির কাজ নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকার কথা ৪০০ অ্যানালিস্টের। কিন্তু জমি নেওয়ার সাত বছর পরে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা লগ্নি করেও অফিস চালু করে উঠতে পারেননি কলকাতায় ছোটবেলা কাটিয়ে ইংল্যান্ডে থিতু হওয়া এক ব্যবসায়ী। সিন্ডিকেটের দাপট আর হিডকো-র আইনি চোখরাঙানিতে নিজের শিকড়ে ফেরার স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয় তাঁর। জোড়া চাপে এতটাই সন্ত্রস্ত তিনি, যে নিজের বা সংস্থার নামটুকু পর্যন্ত প্রকাশ্যে আনতে রাজি নন।

ছোট ও মাঝারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার জন্য বাম আমলে রাজারহাটে ৩০ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছিল। লগ্নি টানতে লন্ডনে গিয়েছিলেন তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী। তাঁর প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়েই আরও ৪৭টি সংস্থার সঙ্গে রাজারহাটের প্রকল্প এলাকায় জমি কিনেছিলেন সফটওয়্যার সংস্থার ওই কর্ণধার। তাঁর সংস্থা ‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বা আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করে। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ লেনদেন হয়, তা যাতে হ্যাকারদের কবলে না-পড়ে সেটা নিশ্চিত করাই এই সংস্থার কাজ। কলকাতা থেকে ওই কাজ করানোর পরিকল্পনা ছিল ওই অনাবাসী ভারতীয়ের। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পে ২০ কোটি টাকা লগ্নি করতে চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু সংস্থার অভিযোগ, গোড়া থেকেই নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তাদের প্রকল্প। গোড়াতেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছে বাড়ির নকশার অনুমোদন পেতে। সেই জটিলতা কাটিয়ে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পরে মাথা চাড়া দেয় সিন্ডিকেটের দাপট। সংস্থার দাবি, তাদের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত দফায় দফায় দশ লক্ষ টাকার বেশি আদায় করেছে সিন্ডিকেট। কিন্তু তাতেও সমস্যা মেটেনি। সংস্থার পরিকল্পনা ছিল, ‘রেডিমিক্স কংক্রিট’ দিয়ে নির্মাণ কাজ করার। কিন্তু সিন্ডিকেটের চাপে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে স্থানীয়দের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে ইট-বালি। তার দামও বেশি, গুণমানও খারাপ।

গোদের উপরে বিষফোড়া, প্রকল্প চালু হতে দেরির জন্য হিডকো-র জরিমানা। জমি হাতে পাওয়ার সাত বছর পরেও কাজ শুরু না-হওয়ায় সংস্থার ঘাড়ে ১৫ লক্ষ টাকা জরিমানা চাপিয়েছে হিডকো। সংস্থার দাবি, প্রকল্প চালু হতে দেরির কারণ যে প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা আর সিন্ডিকেটের চাপ, সে কথা হিডকোও জানে। এমনকী, হিডকোর মধ্যস্থতায় সিন্ডিকেটের সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে সংস্থার কর্তাদের। তার পরেও এই জরিমানায় ক্ষুব্ধ সংস্থার কর্ণধার। তিনি জানান, হিডকো-র আধিকারিকদের বিষয়টি জানানোর পরে জরিমানার বদলে একই অঙ্কের টাকা ‘সিকিউরিটি ডিপোজিট’ হিসেবে জমা রাখতে বলা হয়েছে।

রাজারহাটের অন্যতম প্রশাসনিক কর্তা হিডকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন অবশ্য বলেন, “সিন্ডিকেটের বিষয়টি অন্য। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী জমি পাওয়ার পাঁচ বছর পরেও কাজ না-হলে বার্ষিক দশ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হবে।” তবে প্রতিটি সংস্থার ঘটনা খতিয়ে দেখে জরিমানার অঙ্ক বিবেচনা করার দায় অন্য একটি কমিটির বলে জানিয়ে দেবাশিসবাবু বলেন, “সেই কমিটি যা ঠিক করবে, সেই অনুযায়ী টাকা নেবে হিডকো।”

রাজারহাটে ব্যবসায়িক সংস্থা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের শিকার হচ্ছে, এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১১ সালে গোদরেজ সংস্থার জন্য নির্মাণসামগ্রী আনা লরি আটকেছিল সিন্ডিকেটের পাণ্ডারা। ইউনিটেক ইনফোস্পেসে ঢোকার মুখে লরি-পিছু ৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছিল। হুমকি দেওয়া হয়েছিল, টাকা না-দিলে শুধু মাল সরবরাহ বন্ধ করা নয়, লোকজনদেরও আটকে রাখা হবে। এ নিয়ে রাজারহাট থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিল গোদরেজ। কিন্তু বিশেষ কাজ হয়নি। পরে বিষয়টি ‘আপসে’ মিটিয়ে নিয়ে ফের নির্মাণকাজ শুরু করে তারা।

এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই সাহস বাড়ে সিন্ডিকেট-রাজের। এর পর ২০১২ সালে তোলাবাজদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি দফতরে চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিল ক্যাপজেমিনি, জেনপ্যাক্ট, টিসিএস, কগনিজেন্টের মতো সংস্থা। হিডকো এবং পুলিশেরও দ্বারস্থ হয়েছিল তারা। শুধু বেসরকারি সংস্থা নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি-র ৩৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ তোলাবাজির দাপটের কারণেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। পরে প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যস্থতায় সমস্যা মিটলেও প্রকল্পের কাজ অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছে।

‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ সংস্থাটির কাজ থমকে যাওয়ায় শুধু যে আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে তা নয়, এ রাজ্যের ভাবমূর্তিও ধাক্কা খাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকমের মতে, এই ধরনের উঁচু মানের কাজ করেন এমন সংস্থার সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেশি নয়। ফলে তারা কত কোটি টাকার ব্যবসা করল বা কত জনের চাকরি হল তার থেকেও বড় কথা হল, এরা যেখানে কাজ করে সেখানে নজর পড়ে বিশ্বের সেরা আর্থিক সংস্থাগুলির। এই সংস্থাটি কলকাতা থেকে কাজ করতে পারলে ওই সব আর্থিক সংস্থার মানচিত্রে ঠাঁই করে নিতে পারত এ রাজ্য। কিন্তু তার বদলে প্রকল্প ধাক্কা খাওয়ায় রাজ্যের বদনামই ছড়াচ্ছে। তা সত্ত্বেও প্রকল্পের জট ছাড়াতে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না প্রশাসন। উল্টে চাপ দিচ্ছে জরিমানা চেয়ে।

“এখন যাই কোথায়!” প্রশ্ন তিতিবিরক্ত ওই অনাবাসী ব্যবসায়ীর।

syndicate rajarhat hidco kolkata news online kolkata news small industry heavy problem
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy