অসহায়: মেয়ে হরবিন্দরের (ইনসেটে) মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরে ওয়ারিয়ম কৌর। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
পায়ে হেঁটে রেললাইন পেরিয়ে প্রতিদিন সকালে স্কুলে পড়াতে যেতেন তিনি। বুধবার সকালেও ওই ভাবে লাইন পেরোতে গিয়েছিলেন। তখনই ঘটল বিপত্তি। ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হল হরবিন্দর আনন্দ (৫৯) নামে দরগা রোডের এক স্কুলের শিক্ষিকার। পুলিশ জানায়, হরবিন্দরের মোবাইল ফোনটি রেললাইনে পড়ে গিয়েছিল। সেটি তুলতে গিয়ে তিনি খেয়ালই করেননি যে, ওই লাইনেই ট্রেন আসছে। যত ক্ষণে খেয়াল হয়, আর কিছুই করার ছিল না!
পুলিশ জানিয়েছে, পার্ক সার্কাসের আসগর মিস্ত্রি লেনের একটি ফ্ল্যাটে ৭৭ বছরের বৃদ্ধা মা ওয়ারিয়ম কৌরের সঙ্গে থাকতেন হরবিন্দর। তিনি বিয়ে করেননি। প্রতিদিনের মতো এ দিনও সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে স্কুলের জন্য রওনা দিয়েছিলেন। মহম্মদ রহমত নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘‘লাইন পার হওয়ার সময়ে নিচু হয়ে কিছু একটা তোলার চেষ্টা করছিলেন ওই মহিলা। সেই সময়ে ট্রেন ঢুকছে দেখে আমরা সকলে চিৎকার করে ওঁকে সরে যেতে বলি। মহিলার খেয়ালই ছিল না সে দিকে। শেষে যখন বাঁচার চেষ্টা করলেন, অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। ট্রেনের ধাক্কায় লাইনের উপরে ছিটকে পড়েন তিনি।’’ ঘটনাস্থলের পাশেই বসেন মাছ বিক্রেতা জানে আলম। তাঁর কথায়, ‘‘ওই দেখুন, এখনও মহিলার ছেঁড়া জুতো পড়ে রয়েছে। ব্যাগ, মোবাইল— সবই এ দিক ও দিক ছিটকে পড়েছিল। মোবাইলটা তুলতে গিয়েই মারা গেলেন ওই মহিলা।’’
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ঘটনাটি ঘটলেও বেলা ১১টার পরে পুলিশ দেহ তুলে নিয়ে যায়। রেল পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেছে, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেহটি উদ্ধার করা হয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হরবিন্দরকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। পরে দেহটি ময়না-তদন্তের জন্য এন আর এসে পাঠানো হয়।
রেল পুলিশ অবশ্য উল্টে স্থানীয়দের বেপরোয়া ভাবে লাইন পেরোনো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। রেল পুলিশের এক আধিকারিকের বক্তব্য, পার্ক সার্কাস স্টেশনের কাছে একটি লেভেল ক্রসিং থাকলেও অধিকাংশ পথচারীই তা ব্যবহার করেন না। নিজেদের ইচ্ছেমতো লাইন পেরোনোর রাস্তা বানিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। এ দিনের ঘটনাস্থল থেকে মাত্র মিনিটখানেক হাঁটলেই পার্ক সার্কাস লেভেল ক্রসিং। এ দিন দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, সকালের ঘটনা নিয়ে কারও কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। তবে সকলেই মহিলার পরিণতির কথা শুনেছেন। স্কুলফেরতা সন্তানকে কোলে তুলে ওই পথেই বিপজ্জনক ভাবে লাইন পার হচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। এ ভাবে লাইন পেরোচ্ছেন কেন? প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘‘লেভেল ক্রসিং দিয়ে গেলে অনেকটা সময় লাগে। অত সময় কোথায়?’’
দুপুরে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ফেরা অণিমা দত্তবণিক নামে এক মহিলার আবার প্রশ্ন, ‘‘এখানে কেন লেভেল ক্রসিং হবে না? পারাপারের এই রাস্তাও তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ!’’ এলাকাটি কলকাতা পুরসভার ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। স্থানীয় কাউন্সিলর জলি বসু বলেন, ‘‘এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন। যেখানে চাইবেন, সেখানেই লেভেল ক্রসিং বানানো যায় নাকি?’’
হরবিন্দরের মৃত্যুর পরে তাঁর বৃদ্ধা মাকে তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে শয্যাশায়ী বৃদ্ধা বলছেন, ‘‘মেয়েকে বহুবার সাবধান করেছি। আজও ওই লাইন পেরিয়েই যাচ্ছিল নিশ্চয়ই। আমি কার কাছে থাকব, সেটা ভাবল না?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy