Advertisement
E-Paper

‘নম্বরের ইঁদুর দৌড় নয়, ওদের অনাবিল খুশিই তৃপ্তি দেয়’

মাধ্যমিকে নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যখন শামিল রাজ্যের বেশির ভাগ স্কুল। তখন এই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাশ করাকেই বড় সাফল্য মানেন। কারণ, স্কুলের প্রায় প্রত্যেক ছাত্রীই সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে আসা, যাদের বেশির ভাগই ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’।

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৯ ০২:৪৫
বেলঘরিয়ার আবাসনে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে মায়ের সঙ্গে পায়েল। নিজস্ব চিত্র

বেলঘরিয়ার আবাসনে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে মায়ের সঙ্গে পায়েল। নিজস্ব চিত্র

‘‘ওরা পাশ করায় আমরা খুশি। ওরা-আমরা মিলে যে বৃহত্তর পরিবার, এটা তারই বড় সাফল্য।’’— বলছিলেন কান্তা পাল, উত্তর কলকাতার কাশীপুর অমিয়বালা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তিনি।

মাধ্যমিকে নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যখন শামিল রাজ্যের বেশির ভাগ স্কুল। তখন এই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাশ করাকেই বড় সাফল্য মানেন। কারণ, স্কুলের প্রায় প্রত্যেক ছাত্রীই সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে আসা, যাদের বেশির ভাগই ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’। ফলে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাদের তৈরি করা কষ্টসাধ্য বলে দাবি শিক্ষিকাদের। গত কয়েক বছরের মতো এ বারেও স্কুলের সব মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীই কৃতকার্য হয়েছে। যদিও এ বারের সাফল্য বেশি খুশির, মনে করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। কারণ, ২৭ জন পরীক্ষার্থীর তিন জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরী। মূক-বধির পায়েল রায়, অটিস্টিক তিয়াসা গিরি এবং ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ঊর্বী বড়ুয়ার সাফল্যে অবশ্য তিন পরিবারের বড় অবদানের কথা মানছেন কান্তাদি।

পায়েল, তিয়াসা এবং ঊর্বীর মা-বাবা চেয়েছিলেন, সন্তানদের সাধারণ বাচ্চাদের সঙ্গেই পড়াতে। তাঁরা জানান, এক বাক্যে কর্তৃপক্ষ পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি নিয়েছিলেন তিন কন্যাকে।

এত বছর কী ভাবে ওদের আগলে রেখে পড়াশোনায় সাহায্য করেছেন শিক্ষিকারা, বেলঘরিয়া পুলিশ হাউজিং এস্টেটের ফ্ল্যাটে বসে সে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন পায়েলের মা বেবি রায়। কলকাতা পুলিশে কর্মরত পায়েলের বাবা উজ্জ্বলেন্দু রায়। অবসরে নাচ ও আঁকাই ডুবে থাকে পায়েল। এ বার কী নিয়ে পড়বে? সপ্তম শ্রেণি থেকে পায়েলের গৃহশিক্ষক সাধন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “প্র্যাক্টিক্যাল আছে, এমন বিষয় নিয়েই ওকে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি করানো হবে।”

চিড়িয়ামোড়ের বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে তিয়াসা। নিজস্ব চিত্র

ড্রইং খাতায় আপন মনে প্রকৃতি আঁকে তিয়াসা। চিড়িয়ামোড় সংলগ্ন সবজি বাগান বস্তির এক কামরায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে সে। কথা বিশেষ বলেই না মেয়েটি। চোখ নিচু করে নিজের জগতেই থাকে সে। মাঝেমধ্যে চোখ তুলেই ফের নামিয়ে নেয়। ওর কথা ফোটে শুধু গানে। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে মেয়ের বুলি ফুটতেই গানে ভর্তি করে দেন মা শীলা গিরি। বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত বাবা তিমির গিরি, হাজার আর্থিক টানাপড়েনেও মেয়ের কিছুতে ঘাটতি হতে দেননি।

মল রোডের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ঊর্বী। নিজস্ব চিত্র

মল রোডের আবাসনে বসে ঊর্বীর মা অমিতা বড়ুয়া শোনাচ্ছিলেন, জন্মের পর থেকেই ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ সংগ্রামের কাহিনি। ঊর্বীর বাবা, সুভাষচন্দ্র বড়ুয়া বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের কর্মী। মেয়ের শারীরিক এবং মানসিক প্রতিক্রিয়ায় সচেতনতা আনাতে গত পাঁচ বছর ধরে একটি নাটকের দলে শিশু বিভাগের সদস্য ঊর্বী।

বাড়ির প্রিয়তম সদস্যদের এই সাফল্যে স্কুলের ভূমিকার কথাও বলছিলেন ওঁরা। ক্লাসে অন্যদেরকে করা প্রশ্ন ওদের জন্য বোর্ডে লিখে, সবার আগে ওদের খাতা দেখে, ওদেরকে আগ্রহী পড়ুয়ার পাশে বসিয়ে, নিয়মিত অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তবেই এসেছে সাফল্য।

নাসরিন, জুলেখা, বনিতারা শোনাচ্ছিল, টেস্টের পর থেকে দিদিমণিরা কী ভাবে ওদের প্রতি কড়া নজর রাখেন। প্রত্যেক দিদিমণি ‘দত্তক’ নেন তিন জন ছাত্রীকে। টেস্ট পরবর্তী স্কুলের বিশেষ ক্লাসে যা পড়ানো হচ্ছে, তা ওরা পড়ছে কি না, রুটিন অনুসরণ করছে কি না, সে সব জানতে দিনে কয়েক বার ফোন করেন দিদিমণিরা। কোনও ছাত্রীর আর্থিক বা সামাজিক পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে, তাকে বাড়িতে রেখে পড়ান শিক্ষিকা। প্রতি মাসে দিদিমণি ও অশিক্ষক কর্মীদের মাইনে থেকে নির্দিষ্ট টাকা জমা পড়ে একটি তহবিলে। ছাত্রীদের প্রয়োজন মতো বই, স্কুলের মাইনে, ওষুধ বা চিকিৎসার জন্য সেখান থেকে খরচ করা হয়। “বেশিরভাগ স্কুল এবং সংবাদমাধ্যম নম্বরের নিরিখে সাফল্য প্রচার করে। নম্বরের ইঁদুর দৌড়ে নয়, ওদের অনাবিল খুশিই আমাদের তৃপ্তি দেয়।” বলছিলেন শিক্ষিকা নির্ঝরা দত্ত।

সেই অনাবিল খুশিতেই বায়না করে মাকে দিয়ে আলমারি খুলিয়ে নিজের ছবি, উপহার আর আঁকার সম্ভার বার করে আনে পায়েল। লজ্জামাখা মুখে ঊর্বী বলে, “বন্ধুরা, দিদিরা সবাই ভালোবাসে। আমিও...।” লাল হওয়া পত্রিকায় ঢাকা দরমার চালের ঘর থেকে তিয়াসার গান ভেসে আসে, ‘নব আনন্দে জাগো’।

Specially Abled Student Madhyamik Examination Autism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy