কার্তুজ-কাণ্ডে গোয়েন্দাদের নজরে বি বা দী বাগের লাইসেন্সপ্রাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান। শনিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তল্লাশি চালানোর পরে দোকানের ভূমিকাও সন্দেহজনক বলে মনে করছেন রাজ্য পুলিশের এসটিএফের তদন্তকারীরা। ওই রাতে দোকান থেকে তল্লাশি সেরে বেরিয়ে তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, দোকানের স্টক রেজিস্টারের সঙ্গে কার্তুজের স্টকের মিল নেই। গত কয়েক বছরের স্টকের হিসাব দেখতে গিয়ে বেশ কিছু গরমিল ধরা পড়েছে। পাশাপাশি, রবিবার কার্তুজ-কাণ্ডের তদন্তে আরও এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতের নাম ফারুক মল্লিক। ফারুকের কাছ থেকে একটি দোনলা বন্দুকও উদ্ধার হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, দোনলা বন্দুকটি বি বা দী বাগের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ওই দোকান থেকে বেআইনি ভাবে বিক্রি করা হয়েছিল।
তবে শুধু বি বা দী বাগের দোকানটিই নয়, আরও কয়েকটি দোকানের ভূমিকাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। গোয়েন্দাদের একটি দল শনিবার তল্লাশির শেষে দোকানের কার্তুজের স্টক এবং রেজিস্টার বাজেয়াপ্ত করে। দোকানটিও সিল করে দেওয়া হয়। তবে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। জানা গিয়েছে, স্টক রেজিস্টারের সঙ্গে দোকানে থাকা কার্তুজ মিলিয়ে দেখার কথা পুলিশের। নিয়মিত সেই রেজিস্টার মেলানোর কথা। গোয়েন্দাদের অনুমান, তা না হওয়ার ফলেই বেআইনি অস্ত্র কারবারিদের কার্তুজ পাচার করা হচ্ছিল।
কিন্তু কী ভাবে কার্তুজ বাইরে বিক্রি হচ্ছিল? গোয়েন্দাদের অনুমান, আগ্নেয়াস্ত্র খারাপ হলে তার মেরামতি ওই দোকানেই করা হয়। মেরামতির পরে আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষার জন্য কার্তুজের ব্যবহার করা হত। দোকানে রাখা বালির বস্তাতে গুলি করে সেই পরীক্ষা করা হত। অভিযোগ, যত পরিমাণ কার্তুজ অস্ত্র পরীক্ষার জন্য দেখানো হয়, আদতে তা ব্যবহার করা হয় না। ওই অতিরিক্ত কার্তুজই বাইরে বিক্রি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। এর সঙ্গেই, লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুকের মালিকেরা প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্তুজ পেয়ে থাকেন। অভিযোগ, অনেক বন্দুকের মালিক বছরের পর বছর কার্তুজ নেন না। সেগুলিও বেআইনি ভাবে বিক্রি করা হচ্ছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। শুধু এই দোকান নয়, শহরের আরও পাঁচটি দোকান গোয়েন্দাদের নজরে রয়েছে। সেই সব দোকান থেকেও বেআইনি ভাবে কার্তুজ এবং দোনলা বন্দুক বিক্রি করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
কার্তুজ-কাণ্ড প্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল শুক্রবার। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ওই দিন বিকেলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জীবনতলায় হানা দেয় পুলিশ। ১৯০ রাউন্ড কার্তুজ, একটি পিস্তল-সহ চার জনকে গ্রেফতার করা হয় ওই দিন। ধৃতদের নাম জয়ন্ত দত্ত, আব্দুল সেলিম গাজি, আশিক ইকবাল, হাজি রশিদ মোল্লা। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই ফারুকের নাম সামনে আসে। এর পরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতের কাছ থেকে একটি বন্দুক ছাড়াও চার রাউন্ড গুলি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তদন্তে জানা গিয়েছে, হাজি রশিদ মোল্লার কাছ থেকে এই দোনলা বন্দুকটি কিনেছিলেন ফারুক। বি বা দী বাগের দোকানে কর্মী জয়ন্তের থেকে হাজি রশিদ মোল্লার হাত ঘুরে ফারুকের কাছে এই আগ্নেয়াস্ত্রটি গিয়েছিল বলে অনুমান।
বি বা দী বাগের দোকানের স্টক রেজিস্টার নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে দোকানের মালিক-সহ কয়েক জন কর্মীকে। উল্লেখ্য, দোকানে কত পরিমাণ কার্তুজ আসছে, কতটা বিক্রি হচ্ছে, কত পরিমাণ কার্তুজ রয়েছে— তার যাবতীয় তথ্য থাকার কথা স্টক রেজিস্টারে। রেজিস্টার অনুযায়ী যত সংখ্যক কার্তুজ স্টকে থাকার কথা, সেই পরিমাণ কার্তুজ দোকানে মেলেনি বলে অভিযোগ। ফলে বেআইনি পথে তা বিক্রি করে দুষ্কৃতীদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছিল, এমনটাই মনে করছেন রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা।
এক গোয়েন্দা কর্তার মতে, ‘‘স্টক ঠিক আছে কিনা, সে বিষয়ে কিছুই খোঁজখবর রাখা কিংবা খতিয়ে দেখা হত না। দোকানের কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশের একাংশ ওই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। এই অস্ত্র পাচার চক্রে দোকানের কর্মী জয়ন্ত ছাড়াও আর কেউ জড়িত আছেন কিনা, সেই খোঁজ শুরু হয়েছে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)