দুনিয়া জুড়ে চলছে শিল্পের বিপ্লব। জায়গার ব্যবহারে নতুনত্ব থেকে শুরু করে পরিচিত জিনিসে অচেনা সৃষ্টি সবই ধরা পড়ছে সেই ভাবনায়। ইনস্টলেশন আর্ট এ ভাবেই নিজের জায়গা করে নিচ্ছে এ কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম হিসেবে।
কিন্তু নিত্যনতুন শৈলিতে ত্রিমাত্রিক স্পেসের ব্যবহার বাঙালির কাছে নতুন নাকি? সারা বিশ্বে ইনস্টলেশনের ভাবনা আধুনিক হলেও দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির কাছে এই শিল্প ধারণা বড় হয়ে ওঠার অন্যতম অঙ্গ। মার্কিন কবি এলিয়ট লিখে গিয়েছেন, কোনও সৃষ্টিই শুধু এক ব্যক্তির গুণের প্রকাশ নয়, তাতে থেকে যায় ঐতিহ্যের ছাপও। ঠিক তেমনই ইনস্টলেশন শিল্প আসলে বাংলার মণ্ডপ-প্রতিমা শিল্পের ভাবনাকে আরও বড় আকারে নিয়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে। আবার কলকাতার আনাচকানাচে প্রতি শরতে গড়ে ওঠা এক-এক টুকরো শিল্প আরও একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইনস্টলেশনের অভিনবত্বকে। কখনও ঐতিহ্য মেনে, কখনও বা নতুনত্বের আহ্বানে শিল্পের উপকরণ হয়ে উঠছে বোতাম, সুতোর রিল, ফুলের সাজি থেকে শুরু করে বাঁশি, ফেলে দেওয়া বোতলের ঢাকনা, বাঙালি বধূদের হাতের শাঁখা-পলা। ত্রিমাত্রিক স্পেসকে আরও একটু অভিনব করে তোলার প্রয়াসে এ ভাবেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে শহর কলকাতা।
হরিদেবপুর নিউ স্পোর্টিং ক্লাব যেমন এ বার মণ্ডপ সাজাচ্ছে বোতাম দিয়ে। থিম ‘বোতামে বোধন’। একসঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার ভাবনাকে শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেই এ বছর সজ্জার উপকরণ হিসেবে বোতামকে বেছে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। টালিগঞ্জ আদি বারোয়ারি দুর্গোৎসব কমিটি আবার সেই বাঁধনের প্রসঙ্গকেই তুলে ধরতে থিমে ব্যবহার করছে সুতোর রিল।
বেহালার প্রগতি সঙ্ঘ সর্বজনীনের ইনস্টলেশন আবার তুলে ধরছে বাংলার আরও এক শিল্পকে। সেখানে মণ্ডপ সাজবে ফুলের সাজি দিয়ে। বাঁশ বা বেতের তৈরি ফুলের সাজিতে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় লোককথাও ফুটিয়ে তোলা হয়। সে সব সাজির নানা রকম রং ও নকশার ব্যবহার মণ্ডপ প্রাঙ্গণে আনবে অভিনবত্ব। মূল মণ্ডপও গড়া হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড সাজির আদলে।
বাংলার লোকশিল্পের শোকেস হয়ে উঠবে গড়িয়া সর্বজনীনের মণ্ডপও। নানা রকম বাঁশি দিয়ে তৈরি হচ্ছে ইনস্টলেশন। মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে বড় একটি বাঁশির আদলে। তবে এটি শুধু লোকশিল্পের ব্যবহারে একটা নতুন থ্রি ডি স্পেসের সৃষ্টিই নয়, ধরে রাখছে আরও আকুতির গল্প। পুজো মানেই যে নস্ট্যালজিয়ার সুর, শরতের বাতাস আর বাঁশির মেলবন্ধন যেন ফুটিয়ে তুলবে সেই ভাবনাকেই। বাঁশি, খঞ্জনিতে সাজছে গোপালপুর সর্বজনীনের মণ্ডপও। প্রাঙ্গণ জুড়ে থাকছে সুরের বিভিন্ন যন্ত্রও। প্রতি সন্ধ্যায় থাকছে বাউল ও লোকগীতি।
উত্তর কলকাতার লালাবাগান নবাঙ্কুরেও প্রাধান্য পাচ্ছে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি। ব্যস্ত শহরের গলিতেই কয়েক দিনের জন্য তৈরি হবে পল্লিজীবনের এক টুকরো। উপকরণ মূলত বাঁশ আর মাটি। দমদমের তরুণ দলের ভাবনার গতিও সে দিকেই। বাংলার সংস্কৃতির জন্য নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে উদ্যোগী তারা। বাঁশের কাজের মণ্ডপ-প্রাঙ্গণে দেখা মিলবে পেখম মেলা ময়ূর, ছেঁড়া মেঘ, কাশবনের। জপুর ব্যায়াম সমিতি আবার এই শরতকে বেছে নিয়েছে বিশ্ব জুড়ে বিছিয়ে থাকা জালের ব্যাখ্যা খুঁজতে। বাংলার লোক-জীবনের একটা দিক ফুটে উঠছে এখানকার মণ্ডপসজ্জাতেও। চারদিকে যে সব জালে ফেঁসে বদলে যায় মানুষের জীবনের গতি, তারই প্রতীক হিসেবে মণ্ডপ সাজছে মাছ ধরার জাল দিয়ে। প্রতিমা বসবেন জেলে নৌকোয়।
সমকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ট্রেন্ডের সঙ্গে পুজোর ঐতিহ্যকে এক করছেন শহরের আরও তিনটি পুজোর উদ্যোক্তারা। নাকতলার পল্লি উন্নয়ন সমিতির এ বারের ভাবনা পুনর্ব্যবহার ঘিরে। তাদের থিম ‘কোনও কিছুই নয় ফেলনা, এসো গড়ি নিত্য নতুন খেলনা।’ ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, রঙিন কাগজ, রবারের কর্ক সবই ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে মণ্ডপ সাজাতে। সিকদারবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির ইনস্টলেশনও হবে অভিনব। মণ্ডপ-প্রাঙ্গণ সাজবে মাশরুম দিয়ে। ব্যবহার করা হবে নানা রঙের, নানা আকারের মাশরুম।
তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীনে এ বারের মণ্ডপসজ্জার উপকরণ ‘ক্যালেন্ডার’। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ-কে মাথায় রেখে সেখানকার থিম ‘দুর্গা বারোমাস্যা’ ইনস্টলেশন শিল্পকে দেবে অন্য মাত্রা। দুর্গাকে নিয়ে এমন শিল্প তো আর দুনিয়ার অন্য কোনও কোণে হওয়ার নয়। শিল্পের মাধ্যমে ঐতিহ্যের এগিয়ে চলার ইতিহাস এ ভাবেই ধরে রাখবে গ্যালারি কলকাতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy