Advertisement
E-Paper

ভর্তি করে চলে যান, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই

পর্ণশ্রী এলাকার নেশামুক্তি কেন্দ্রের ছাদ থেকে পড়ে গত রবিবার মৃত্যু হয় আবাসিক এক যুবকের। এর পরেই প্রশ্ন ওঠে এমন সব কেন্দ্রের পরিকাঠামো নিয়ে। কী ভাবে চলছে শহরের বিভিন্ন নেশামুক্তি কেন্দ্র? সে সব জায়গায় পরিষেবার কী হাল? ভর্তি করার কথা শুনেই জানতে চাওয়া হল সংশ্লিষ্ট মাদকাসক্ত ব্যক্তির খুঁটিনাটি তথ্য। কী ভাবে ভর্তি করা হবে, কোন কোন ডাক্তার দেখবেন—পাল্টা সে প্রশ্ন করতেই প্রায় মুখস্থ বলার মতো তরুণী ও দুই যুবক জানালেন, ভর্তির দিনে এক চিকিৎসক দেখবেন।

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০১:০০

পাঁচিল ঘেরা দোতলা বাড়ির চত্বরে ঢুকতেই চোখে পড়ল একতলার ঘেরা বারান্দা। সেটির সামনে আরও একটি গ্রিলের গেট. বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে নেশামুক্তি কেন্দ্রের নামের লম্বা টানা হোর্ডিং।

আগে থেকে ফোন করে যাওয়ায় অপেক্ষা করছিলেন এক তরুণী। তিনিই গেটের তালা খুলে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বসে রয়েছেন বছর ৩০-৩৫ বয়সী দুই যুবক। সেই ঘরেরই একটি পাশে একটি কাঠের দরজা। তবে সেটিতে ছিটকিনি তোলা। বোঝা গেল দরজার ও পাশে কী ঘটছে তা বাইরের লোকের জন্য নয়।

ভর্তি করার কথা শুনেই জানতে চাওয়া হল সংশ্লিষ্ট মাদকাসক্ত ব্যক্তির খুঁটিনাটি তথ্য। কী ভাবে ভর্তি করা হবে, কোন কোন ডাক্তার দেখবেন—পাল্টা সে প্রশ্ন করতেই প্রায় মুখস্থ বলার মতো তরুণী ও দুই যুবক জানালেন, ভর্তির দিনে এক চিকিৎসক দেখবেন। তার পর থেকে মাদকাসক্তকে রাখা হবে ‘ডি-অ্যাডিকশন’ ঘরে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। জানা গেল, কেন্দ্রের নিউরো-সাইকায়াট্রির ডাক্তার শুধুমাত্র বুধবার আসেন। তার আগে রোগী ভর্তি হলে নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্মীরাই রোগীকে ওষুধ দেবেন। সেই ওষুধ খেয়ে রোগী শুধু ঘুমোবেন আর খাবার খাবেন। তবে ঘুমোনোর জন্য কোনও খাট পাওয়া যাবে না।

তা হলে?

প্রশ্ন শুনে এক তরুণ জানালেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তি খাটে মাথা ঠুকতে পারেন, সেই আশঙ্কায় মেঝেতে বিছানা করে দেওয়া হয়। মেঝেতে শোওয়ার কথা বলে আশ্বস্ত করতেই তরুণী এবং দ্বিতীয় যুবক বললেন, ‘‘কোনও চিন্তা করবেন না। এক বার রেখে যান। এক মাস পরে এসে দেখবেন রোগী পুরো শান্ত। নিজেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন।’’ তবে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা বা দেখা করার কোনও অনুমতি পরিবারের নেই বলেই জানানো হল। পরিবার শুধু ফর্ম পূরণ করে টাকা দিয়ে দেবে। বাকি সব কিছুই নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্মীরাই করবেন।

কিন্তু এ কোন ধরনের নিয়ম?

চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর পরিবার দেখা করতে পারবে না! এটাই এই কেন্দ্রের নিয়ম। জানিয়ে দিলেন তিন কর্মী। তাঁরা নিজেরাও এক সময় মাদকাসক্ত ছিলেন। এখন পুরো কেন্দ্র তাঁরাই সামলান। তবে অনেক জোরাজুরির পরে কেন্দ্রের মালিককে তরুণী ফোনে ধরালে তিনি ও পার থেকে আশ্বাস দিলেন, ‘‘কোনও চিন্তা করবেন না। ভর্তি করে দিয়ে যান। রোগী ভাল হয়ে যাবে।’’ কিন্তু নিজের ফোন নম্বর দিতে চাইলেন না। কার্ডে বা হোর্ডিংয়ে যে নম্বর আছে সেই নম্বরেই ফোন করতে বললেন।

নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হল চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও সুযোগ নেই। ভর্তির ১৫ দিন পরে প্রয়োজনে ডেকে পাঠানো হবে। তখন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা যাবে। তাও আগে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে জোরাজুরি করতেই বেশ বিরক্ত হয়েই তরুণীর প্রশ্ন, ‘‘আপনি ভর্তি করতে চান তো? আপনি শুধু ঠিকানা বলে দেবেন। বাড়ি থেকে এনে আমরা সব করব। এত কিছু আপনার জানার প্রয়োজন নেই। আপনি তো কেন্দ্র চালান না।’’

কিন্তু তাও নিজের পরিবারের লোককে রাখব, জানব না? এ বার তরুণীর ছোট্ট উত্তর, ‘‘আমরা জানি ডি-অ্যাডিকশনের ওষুধ কী কী দিতে হয়।’’ তিনি কি ডাক্তার? উত্তর এল, এ জন্য ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এটি বেহালার রাজা রামমোহন রায় রোডের একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের নেশা ছাড়ানোর চিকিৎসা পদ্ধতি।

পুলিশের রেকর্ড বলছে, ২০১৮ সালের মে মাসে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে এই কেন্দ্রের কর্ণধার পকসো আইনে গ্রেফতার হয়। বছর খানেক আগে এখানেই এক আবাসিকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগও সামনে আসে। পুলিশ অবশ্য জানে বর্তমানে কেন্দ্রটি বন্ধ।

এমনই আর একটি কেন্দ্র গড়িয়ার কন্দরপুরে। ই এম বাইপাস এবং কামালগাজি মোড়ের কাছে ঘিঞ্জি এলাকার ভিতরে তিনতলা একটি বাড়িতে চলে নেশামুক্তি কেন্দ্রটি। সেখানে পৌঁছতে পর্দা টাঙানো কোল্যাপসিবল গেট খুলে দিলেন এক জন। চোখে পড়ল লম্বা হলের মাঝে কাপড়ের পর্দা ঝুলছে। দু’ধারেই ছোট ছোট ঘর। একটি ঘরে অফিস চলে। বাকি ঘরগুলি রোগীদের জন্য। এক-একটি ঘরে চার জন করে ঘেঁষাঘেষি করে থাকেন। মেঝেতে বিছানা পাতা। এই কেন্দ্রে আবার মেয়েদেরও রাখা হয়।

জানা গেল, বাড়ির একতলা এবং তিনতলায় ছেলেরা থাকেন। দোতলার কিছু ঘরে মেয়েরা আর বাকি ঘরগুলি ভিআইপি রোগীদের জন্য। ওই সব ঘরে অবশ্য এক জন একাই থাকবেন। শোওয়ার জন্য খাটও পাবেন। তবে তার জন্য পরিবারকে কয়েক হাজার টাকা বেশি গুনতে হবে। এখানেও দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন পুরনো মাদকাসক্তেরা। এখানকার মালিক রাম মণ্ডল জানান, এক সময়ে মদে আসক্ত হয়ে তিনি নিজেই নেশামুক্তি কেন্দ্রে ছিলেন। তাঁর দাবি, সুস্থ হয়ে তিনি ঠিক করেন নেশামুক্তি কেন্দ্র খুলবেন। বছর চারেক আগে তিনি এই কেন্দ্র খুলেছেন।

পরিসংখ্যান বলছে কলকাতা শহর এবং শহরতলির বেশির ভাগ নেশামুক্তি কেন্দ্রই চলে এ ভাবে। সোনারপুর থানার অধীনে নরেন্দ্রপুরের একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে গত বছর এক রোগীকে মাদক ছাড়ানোর নামে পিটিয়ে মারার অভিযোগ ওঠে।.কবরডাঙা এলাকার একাধিক নেশামুক্তি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে সেখানে রোগী ভর্তি করতে গেলে পরিবারের লোকজন রোগী কোথায় কী ভাবে থাকবেন তা জানতে পারবেন না।

কলকাতা পুলিশের এক সময়ের নার্কোটিক্স বিভাগের দায়িত্বে থাকা এক অফিসার জানান, এ ধরনের কেন্দ্র খুলতে সংস্থাটিকে সোসাইটি আইনে রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর থেকে মেন্টাল হেলথ লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু গুটি কয়েক সংস্থা ছাড়া এই লাইসেন্স প্রায় কারোরই নেই! আর নজরদারি? সেটা কে করেন তা তিনি কেন কেউ-ই জানেন না বলেই দাবি সমাজ কল্যাণ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার। আর স্বাস্থ্য দফতর? স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীকে ফোন করলে ফোন বেজে গিয়েছে। মেলেনি এসএমএসের উত্তরও। (চলবে)

Rehabilitation Center Mental Patient Police Licence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy