Advertisement
১১ মে ২০২৪

অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার মাসুল দেয় বর্ষার শহর

জুলাইয়ের শেষে ভারী বর্ষণে প্রায় ডুবে গিয়েছিল শহর কলকাতা। এতটাই যে, শহরের ৫৮টি ওয়ার্ডে বন্যার পরিস্থিতি হয়েছিল বলে নবান্নে রিপোর্ট পাঠায় পুর-প্রশাসন। এমনকী, রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র নিজেই সাংবাদিকদের কাছে তা জানিয়েছিলেন।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৩০
Share: Save:

জুলাইয়ের শেষে ভারী বর্ষণে প্রায় ডুবে গিয়েছিল শহর কলকাতা। এতটাই যে, শহরের ৫৮টি ওয়ার্ডে বন্যার পরিস্থিতি হয়েছিল বলে নবান্নে রিপোর্ট পাঠায় পুর-প্রশাসন। এমনকী, রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র নিজেই সাংবাদিকদের কাছে তা জানিয়েছিলেন। যদিও পুরবোর্ডের কর্তারা সে সময়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কম সময়ে বেশি বৃষ্টি এবং ভরা কোটালের জন্যই শহর জলমগ্ন হয়েছিল।

বাস্তবে কি তা-ই? পুরসভারই একটি রিপোর্ট অবশ্য অন্য কথা বলছে। যা থেকে পরিষ্কার শুধু ভরা কোটাল নয়, বছর পাঁচ ধরে পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের ‘অবৈজ্ঞানিক’ পরিকল্পনার মাসুল দিতে হচ্ছে শহরবাসীকে।

কী সেই ‘পরিকল্পনা’?

পুরসভার ওই রিপোর্ট বলছে, মধ্য কলকাতার তিনটি বড় রাস্তার নিচ দিয়ে নিকাশি নালার জল গিয়ে পড়ছে চতুর্থ একটি রাস্তার নীচের নালায়। মধ্য কলকাতার ওই তিনটি রাস্তার একটি হল শ্যামবাজার থেকে মৌলালি পর্যন্ত প্রসারিত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, ধর্মতলা থেকে মৌলালি পর্যন্ত লেনিন সরণি এবং রেসকোর্সের কাছ থেকে মৌলালি আসা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড। আর ওই তিন রাস্তার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার একটি বড় অংশের নিকাশির জল। যা স্বাভাবিক গতি বজায় রেখেই গিয়ে পড়বে সিআইটি রোডের পাশে। যা ‘টাউন আউটফল’ হিসেবে পরিচিত। সেখান থেকে চলে যাবে পামারবাজার পাম্পিং স্টেশনে। বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই তৈরি হয়েছিল পুরোটা। কিন্তু পরিকল্পনার ত্রুটিতে এখন পুরো প্রক্রিয়াটাই অকেজো হয়ে পড়েছে।

গলদ কোথায়? এক পুর-আধিকারিকের কথা, জলের প্রবাহ তো নিম্নগামী। তাই যে রাস্তার নিচ দিয়ে মানুষের ব্যবহৃত জল নিকাশি নালার মাধ্যে প্রবাহিত হয়ে অন্য নালায় পড়বে, সেটা নিচু হতেই হবে। এখানে ঠিক তার উল্টো। যে নালায় জল পড়ার কথা, সেটি উচুঁতে। ফলে জল সেখানে পৌঁছেই স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। আটকে থাকছে জল।

ওই রিপোর্ট লেখা হয়েছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে লেনিন সরণি, এপিসি এবং এজেসি বসু রোডের নীচে নিকাশি নালায় দীর্ঘকাল জমে থাকা পলিমাটি, জঞ্জাল সাফ (ডিসিল্টিং) করা হলেও যে রাস্তার নীচের নালা দিয়ে জল বেরোবে (টাউন আউটফল), সেখানে কোনও কাজ করা হয়নি। স্বভাবতই টাউন আউটফলে জমে থাকা পলিমাটি উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়েছে নিকাশি নালার। ৭ ফুটেরও বেশি।

পুরসভার দেওয়া ওই রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, লেনিন সরণি, এপিসি, এজেসি, কলুটোলা, নিমতলা রোডের নীচে নিকাশি নালার পলিমাটি পরিষ্কার এবং বিশেষ ধরনের পাইপ (জিআরপি লাইনার) বসানোর জন্য প্রায় ৩০৭ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। পাঁচ বছর আগে। অথচ, আজ পর্যন্ত টাউন আউটফলের পলি পরিষ্কারের কাজ হয়নি। তাই কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে কাজ করা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে অপচয় বলেই মনে করছেন রাজ্যের সেচ দফতরের বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘টাউন আউটফলের কাজটা একই প্রকল্পের মধ্যে রাখতে হত। এত বড় ভুল কেন পুরসভার সংশ্লিষ্ট দফতর করল, বুঝতে পারছি না।’’

পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারেরা যে এটা বোঝেননি, তা কিন্তু নয়। রিপোর্টে নিকাশি দফতরের স্পেশ্যাল অফিসার অমিত রায় আলাদা নোট দিয়ে লিখেছেন, টাউন আউটফলের পলিমাটি সরানোর কাজটাও খুবই জরুরি। তা না হলে ওই তিন রাস্তার নিকাশির কাজ ব্যাহত হবে এবং পরিষ্কার থাকা নিকাশি নালাতেও ফের পলি জমতে থাকবে। কিন্তু নোট দেওয়াতেই শেষ। গত পাঁচ বছরে গত তৃণমূল বোর্ডে কোনও কাজ হয়নি। ২০১০ সালে শোভন চট্টোপাধ্যায়কে বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল সিএজি-র রেসিডেন্ট অডিট অফিসার। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, এটা আর্থিক অপচয়। শোভনবাবু দ্বিতীয় বার মেয়রের চেয়ারে বসেও একই চিঠি পেয়েছেন।

কী বলছে পুর-প্রশাসন?

টাকার অভাবেই তা নাকি করা যায়নি, এমনই অজুহাত এখন খাড়া করতে চাইছেন নিকাশি দফতরের এক পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার। আর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘ঠিক হয়েছিল পরে কাজটা করা হবে। এখন বুঝতে পারছি, প্রথম পরিকল্পনার সঙ্গে কাজটা যুক্ত করতে পারলেই ভাল হত।’’ কোটি কোটি টাকা খরচের পরেও সমস্যা থেকে যাওয়ায় নিজেদের ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলতে এখন একে অন্যের দোষারোপ শুরু করেছেন। নিকাশি দফতরের মেয়র পারিষদ তারক সিংহ অবশ্য ওই সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘‘অনেক আগের ঘটনা। খোঁজখবর নিচ্ছি।’’ তবে কাজ যে দ্রুত করা প্রয়োজন, তা জানাতে ভোলেননি।

মধ্য কলকাতার একাধিক তৃণমূল কাউন্সিলরের কথায়, এ বার শহর জলমগ্ন হওয়ার অন্যতম কারণ এটিও। ভারী বৃষ্টি হলেই জল সরতে চায় না। ওই তিন রাস্তার সঙ্গে অনেক এলাকার জল আটকে থাকে। এই সমস্যা দূর না হলে কলকাতা বারবার ভুগবে, জানালেন পুরসভার বিশেষজ্ঞেরাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Unscientific outlet Kolkata drain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE