Advertisement
E-Paper

পুরনো ‘প্রেম’ হারিয়ে কাতর বিশাল-হৃদয়

প্রিয়তম নারীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে যেতে দেখলে হৃদয় খুঁড়ে ঠিক কতটা বেদনা জেগে ওঠে? খুব তাড়াতাড়ি সেই অভিজ্ঞতা হতে চলেছে বিশালের। কারণ রূপার পাত্র ঠিক করে ফেলেছেন তার অভিভাবকেরা।

সৌভিক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৮

প্রিয়তম নারীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে যেতে দেখলে হৃদয় খুঁড়ে ঠিক কতটা বেদনা জেগে ওঠে? খুব তাড়াতাড়ি সেই অভিজ্ঞতা হতে চলেছে বিশালের। কারণ রূপার পাত্র ঠিক করে ফেলেছেন তার অভিভাবকেরা।

বিশাল আর রূপার মেলামেশা বহু দিন বন্ধ হয়ে গেলেও দেখাসাক্ষাৎ হত। এ বার সেটুকুও বন্ধ হয়ে যাবে। কিছু দিনেই ওড়িশার নন্দনকানন থেকে পাত্র আসবে। তার পরেই রূপা আর তার নতুন সঙ্গীর জন্য বরাদ্দ হবে নতুন খাঁচা।

বিশাল ও রূপা আলিপুর চিড়িয়াখানার দু’টি সাদা বাঘ। তারা সহোদর। রূপার বয়স ১১ (জন্ম ২০০৫), বিশাল এক বছরের ছোট (জন্ম ২০০৬)। বাবা অনির্বাণ সাদা বাঘ, মা কৃষ্ণা অবশ্য সাধারণ বাঘিনী।

আলিপুর চিড়িয়াখানার ডিরেক্টর আশিসকুমার সামন্ত জানান, ছোট থেকে এক সঙ্গেই বড় হয়েছে ভাই-বোন। রূপাকে চোখে হারাতো বিশাল। যদিও বিশালের প্রতি রূপার টান কোনও দিনই অতটা বোঝা যায়নি। কিন্তু তাদের এই মেলামেশা ভাল চোখে দেখেননি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। তাই যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পরেই প্রেমে নেমে আসে নিষেধাজ্ঞা। দু’টি আলাদা খাঁচায় পাশাপাশি তাদের রাখা হয়।

কিন্তু কর্তৃপক্ষ কেন এতটা নিষ্ঠুর?

আশিসবাবু জানান, ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ওদের আলাদা রাখা হয়েছে। বিশাল ও রূপা একই মা বাবার সন্তান হওয়ায় তাদের মিলনে যে সন্তান জন্মাবে, তার জিনগত সমস্যা হতে পারে। তাই একটু বড় হওয়ার পরে রূপার প্রতি বিশাল আকৃষ্ট হচ্ছে দেখে আলাদা খাঁচায় রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আশিসবাবু বলেন, ‘‘বিশালকে খুব একটা বাইরে বার করা হয় না। যে সাদা বাঘটিকে দর্শকেরা দেখেন, সে রূপা।’’

কেন সাদা

রং ছাড়া রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে ভারতীয় সাদা বাঘের আর কোনও পার্থক্য নেই। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ‘জিন মিউটেশন’ই এর জন্য দায়ী। ‘ফিওমেলানিন’ নামে এক বিশেষ পিগমেন্টের জন্যই ভারতীয় বাঘের লোমের রং কমলা হয়। এই পিগমেন্টের অভাবেই কিছু বাঘের লোমের রং সাদা। এদের কখনও কখনও ‘অ্যালবিনো টাইগার’ বলা হয়ে থাকে।

১৯৫১ সালে মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জঙ্গলে একটি ন’মাসের সাদা বাঘ ধরা পড়ে। রেওয়ার রাজা সেটিকে গোবিন্দগড়ের প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে নাম রাখেন মোহন। বেগম নামের এক সাধারণ বাঘিনী ও মোহনের মেলামেশায় যে ব্যাঘ্রশিশুগুলির জন্ম হয়, তারা কেউ সাদা চামড়ার ছিল না। পরে রাধা নামের অন্য এক সাধারণ বাঘিনী ও মোহন ১৯৫৮ সালে চারটি সাদা বাঘের জন্ম দেয়। এই প্রথম ভারতে ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’-এর মাধ্যমে সাদা বাঘের জন্ম হয়। পরবর্তীতে নীলাদ্রি, হিমাদ্রি নামে দু’টি সাদা বাঘ এবং মালিনী নামে এক সাধারণ বাঘিনীর জন্ম দেয় রাধা। নীলাদ্রি, হিমাদ্রি এবং মালিনীকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। এরাই আলিপুরের সমস্ত সাদা বাঘের আদি পিতামহ-পিতামহী।

রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য বনপাল অতনু রাহা জানান, জঙ্গলেও বাঘেরা অনেক ক্ষেত্রে ভাই-বোনে মেলামেশা করে। তবে বাঘেরা যে হেতু বড় হয়ে আলাদা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, তাই যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের অনেক বিকল্প থাকে। একই পরিবারের মধ্যে প্রজননের সম্ভাবনাও কমে যায়। তিনি জানান, চিড়িয়াখানায় জীবজন্তু রাখার কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে ‘সেন্ট্রাল জু অথরিটি’। সাদা বাঘ জাতীয় বিরল প্রাণীদের প্রজননেও কিছু কড়াকড়ি আছে। তিনি বলেন, ‘‘প্রজননের জন্য যখন যথেষ্ট বাঘ রয়েছে, তখন ভাই-বোনে প্রজনন ঘটিয়ে জিনগত বৈচিত্র কমানোর কী দরকার?’’

কিন্তু এক সমস্যা এড়াতে গিয়ে অন্য সমস্যায় চিড়িয়াখানার কর্তারা। আলাদা হওয়ার পরে অন্য কোনও বাঘিনীর দিকে ফিরেও দেখেনি বিশাল। সময়ের সঙ্গে রূপার কাছে ফিকে পুরাতন প্রেম। অন্য বাঘেদের সঙ্গে তার কিঞ্চিৎ বন্ধুত্বও হয়েছে। চিড়িয়াখানা সূত্রের খবর, বেশ কয়েক বার চিড়িয়াখানার কয়েকটি সাধারণ বাঘিনীর সঙ্গে বিশালের মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রত্যেক বারই বিশাল প্রত্যাখ্যান করেছে সঙ্গিনীদের। চিড়িয়াখানার এক কর্মীর সহাস্য মন্তব্য, ‘‘একেবারে সাহেব বাঘ বিশাল। সাদা চামড়া ছাড়া কিছুই মনে ধরে না।’’

আশিসবাবু জানান, বিশালের এমন আচরণের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি তিনি। বরং রূপার আচরণ বেশি স্বাভাবিক। শারীরিক কারণেই দু’জনেরই সঙ্গীর প্রয়োজন। কিন্তু চিড়িয়াখানায় বিশালের সঙ্গিনী হওয়ার মতো সাদা বাঘিনী নেই। অনন্যা নামে একটি সাদা বাঘিনী থাকলেও সে দীর্ঘ দিন ধরেই অসুস্থ। আশিসবাবু বলেন, ‘‘সম্ভবত সাধারণ বাঘের কমলা রং বিশালকে আকর্ষণ করে না। তবে এ কথাটাও এখনই জোর দিয়ে বলার সময় আসেনি। আরও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।’’

কিন্তু রূপার পাত্র মিলল কী ভাবে? আশিসবাবু জানালেন, ওড়িশার নন্দনকানন থেকে চারটি নতুন বাঘ আসার কথা। অন্য বাঘের সঙ্গে বিশাল মিশতে না চাইলেও রূপা খুব আপত্তি করেনি। তাই কিছুদিন পরে বাঘগুলি এলে তাদেরই কারও সঙ্গে রূপাকে পাকাপাকি ভাবে রাখা হবে। বিশালের পাশের খাঁচাটি থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে নবদম্পতিকে।

তবে নন্দনকানন থেকে কোনও সাদা বাঘিনী না আসায় দুঃখপ্রকাশ করেন আশিসবাবু। তিনি জানান, অন্য কোনও সাদা বাঘিনীর প্রতি বিশাল আকৃষ্ট হবে কি না তা এখনই বোঝার উপায় রইল না। তাঁর কথায়, ‘‘বিশালটা আরও একা হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। আমরা সাদা বাঘিনী পাচ্ছি না।’’

তবে আশা ছাড়েননি চিড়িয়াখানার কর্মীরা। তাঁদের মাথায় উঁকি দিচ্ছে অন্য এক সম্ভাবনা। রূপার যখন সন্তান হবে সেগুলির মধ্যে যে একটিও সাদা বাঘিনী থাকবে না, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। সেই আশাতেই দিন গুণছেন তাঁরা।

bishal rupa white tiger alipore zoo souvik chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy