Advertisement
০৫ মে ২০২৪

ধরা দেবে কি দেবে না, সংশয়ে ওয়াইফাই-স্ট্রিট

পার্ক স্ট্রিটে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ার খোঁজখবর নিতে এসে দু’টো সাধই অপূর্ণ থেকে গেল সদ্য দ্বাদশ শ্রেণি পাশ দুই তরুণের। বৃহস্পতিবার দুপুরে মহাবীর জয়ন্তী উপলক্ষে ‘ড্রাই ডে’-তে ঝাঁপ বন্ধ ছিল এলাকার অন্যতম প্রাচীন ও নামজাদা একটি পানশালার।

সিগন্যালের খোঁজ।

সিগন্যালের খোঁজ।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৩৩
Share: Save:

পার্ক স্ট্রিটে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ার খোঁজখবর নিতে এসে দু’টো সাধই অপূর্ণ থেকে গেল সদ্য দ্বাদশ শ্রেণি পাশ দুই তরুণের।

বৃহস্পতিবার দুপুরে মহাবীর জয়ন্তী উপলক্ষে ‘ড্রাই ডে’-তে ঝাঁপ বন্ধ ছিল এলাকার অন্যতম প্রাচীন ও নামজাদা একটি পানশালার। পানশালা-অভিযানের মতোই কলকাতার ফ্রি ওয়াইফাই স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে মনপসন্দ একটি গেম ডাউনলোড করার স্বপ্নও এ দিন অধরা থেকে গেল কৌশিক ভট্টাচার্য ও ভিক্টর গুহের। আসন্ন কলকাতা পুরভোটের প্রথম বারের ভোটার, শহরের দক্ষিণ প্রান্তের দুই সদ্যযুবা স্টিফেন কোর্টের পাশে কুইন্স ম্যানসনের নীচে ফোন হাতে দীর্ঘক্ষণ ধস্তাধস্তির পরে হতাশ হয়ে রণে
ভঙ্গ দিলেন।

এ শহরের তরুণদের উপহার দেওয়ার কথা বলে পার্ক স্ট্রিটকে কলকাতার নিখরচার ‘ওয়াইফাই পাড়া’ বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাস দুয়েক আগে (৫ ফেব্রুয়ারি) রিলায়েন্স জিও সংস্থার ৪জি প্রযুক্তির মাধ্যমে এই পরিষেবা চালু হয়। উদ্বোধনী আসরে মঞ্চে শোনা গিয়েছিল জনপ্রিয় গান, ‘বসন্ত এসে গেছে!’ দু’মাস বাদে এ তল্লাটে দুপুরে ঘণ্টা তিনেক ঘোরাঘুরি করে দেখা গেল, বসন্ত দূরের কথা, ‘পাব কি পাব না’-র সংশয়টাই এখনও পুরোপুরি কাটেনি।

কেন এমন দশা ? রাজপথের উত্তর দিকের ফুটপাথে কলম-পেন্সিলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা হকার আনিস রহমান বোঝালেন, মো়ড়ের দিকটায় মানে এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে এবং তার উল্টো দিকের ফুটপাথে ওয়াইফাই-এর যা তেজ, তা সর্বত্র মিলবে না। আবার, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে ওয়াইফাই কানেকশন ঝরঝরে। কিন্তু স্টিফেন কোর্টের দিকের ফুটপাথে তত সহজে ওয়াইফাই-এর দরজা খুলছে না।

ওয়াইফাই-সন্ধানীদের এমন অভিযোগ যে নেহাত অমূলক নয়, তা মানছেন সাইবার বিশেষজ্ঞেরা। গোটা প্রকল্পটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত কলকাতা পুরসভার এক কর্তার ব্যাখ্যা, গোটা পার্ক স্ট্রিটই অনেকগুলি ‘অ্যাকসেস পয়েন্টে’ ছেয়ে ফেলা হয়েছে। ‘ওয়াইফাই কানেকশন’ কতটা জোরালো, তা নির্ভর করছে এই পয়েন্টগুলির সঙ্গে দূরত্বের ভিত্তিতে। কেউ কেউ ঠেকে শিখে এই জায়গাগুলো খুঁজে বার করেছেন। উত্তর দিকের ফুটপাথে একটি কন্টিনেন্টাল ও চিনে রেস্তোরাঁর মাঝখানে রেলিংয়ে বসে গাছে হেলান দিয়েছে খিদিরপুরের একটি স্কুলের দশম শ্রেণির পড়ুয়া আদিল খান। ঠিক যেন শিকারের খোঁজে মোক্ষম জায়গায় মাচা বেঁধে বসা। গেম ডাউনলোড করার ফাঁকে ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে আদিলের দাবি, মোড়ের মাথায় মাঝেমধ্যে সময় বেশি লাগে। সাধারণত, ১২৫ এমবি-র গেম ১৫ মিনিটে ফোন-বন্দি করে ফেলা যায় বলে তাঁর দাবি।

নিয়মিত ওয়াইফাই-শিকারিদের মধ্যে দলে ভারী অবশ্য স্কুল-কলেজের পডুয়ারাই। বছরখানেক আগে বাবার কাছ থেকে পাওয়া উপহার গাব্দা ট্যাব হাতে তাই এশিয়াটিক সোয়াইটির চাতালে আরাম করে বসেছে সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ওঠা হাতিবাগানের অঙ্কিত দাস। ছুটির দুপুরে সহজে নিখরচায় গেম ডাউনলোড করতে একা একাই পার্ক স্ট্রিটে এসে বসে আছে সে। দিনভর পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও কোনও গাড়ির চালকও দিনভর আনন্দে ইউটিউবের গান শুনছেন।

তবে সব দিন সবার ভাগ্য সমান যায় না। জওহরলাল নেহরু রোডের মোড়ের কাছাকাছি রাজপথের দক্ষিণ দিকের ফুটপাথে বেসরকারি ব্যাঙ্কের নীচে দেখা গেল, স্মার্টফোনে ঘাড় গুঁজে জটলা। ব্যাঙ্ককর্মী অলোক মণ্ডল, ছোটু দাসেরা বলছিলেন, ইদানীং ভারী সুবিধা হয়েছে। অফিস থেকে নেমে বাইরে দাঁড়িয়েই আকছার গান শোনা বা ভিডিও ডাউনলোড চলছে। ‘‘তবে কোনও কোনও দিন দরজায় খিল এঁটে বসে থাকে ওয়াইফাই। বড়জোর এক পলকের একটু দেখাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।’’—সহাস্যে বললেন অলোকবাবু।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে মাইক্রোবায়োলজির দ্বিতীয় বর্ষ তামান্না সুলতানার অভিজ্ঞতাও অনেকটা এমনই। এক এক দিন দিনভর যেন টুকি-টুকি খেলার মেজাজ। মোবাইলে বার বার ফুটে উঠতে থাকে ‘জিওনেট নট ইন রেঞ্জ’ বা ‘অ্যাকসেস ডিনায়েড’। পুরসভার এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘একসঙ্গে অনেকে মিলে চেষ্টা করলে কিন্তু মাঝেমধ্যে ওয়াইফাই-এ ঢুকতে ঝামেলা হয়। বিদেশেও হটস্পটগুলোয় অনেক সময় এমন ঘটে থাকে।’’

রিলায়েন্স জিও-র কর্তারা অবশ্য ওয়াইফাই পরিষেবা ‘সুপারহিট’ বলেই দাবি করে চলেছেন। পুরসভা সূত্রের খবর, দু’মাস ধরে এখনও পর্যন্ত অন্তত পাঁচ লক্ষ লোক পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে নিখরচার ওয়াইফাই সংযোগ হাসিল করেছেন। আর সহজে ‘কানেকশন’ না-মেলার অভিযোগ থাকলেও এক এক দিনে ডাউনলোডের বহর বিপুল। গড়ে ১৩ হাজার মেগাবাইট। আর আগামী তিন-চার মাস নিখরচার এ পরিষেবার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তবে রাজ্য সরকারের তরফে ঢাকঢোল পিটিয়ে কলকাতাকে দেশের প্রথম ফ্রি ওয়াইফাই-নগরী বলে ঘোষণা করে দেওয়া হলেও নিখরচার ওয়াইফাই-বরাত আপাতত খানিক দুর্যোগ নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের চৌহদ্দিতেই আটকে থাকছে।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE