Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নমাজের জমায়েতে মুক্তির স্বাদ

প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি পাড়াতে কোনও ফাঁকা ফ্ল্যাট, পরিত্যক্ত অফিসঘর, ক্লাব বা স্কুলবাড়িতে চোখে পড়ছে মেয়েদের এই জমায়েত।

একসঙ্গে: মোমিনপুরের নমাজে মেয়েরা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

একসঙ্গে: মোমিনপুরের নমাজে মেয়েরা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৯ ০১:৩০
Share: Save:

সান্ধ্য নমাজ শুরুর আগে পর্যন্ত ব্যস্ততার শেষ নেই স্থানীয় গিন্নিদের!

কাগজের প্লেটে অতিথিদের জিলিপি, মিষ্টি সাজিয়ে দিয়ে সস্নেহে প্রৌঢ়া মুন্নি বেগম বললেন, ‘‘আমাদের নমাজ, কোরান পাঠ এখন চলবে ঘণ্টা দেড়েক। মিষ্টিটা খেয়ে নিও। বিরিয়ানির প্যাকেটও নিও কিন্তু মনে করে।’’

মোমিনপুর মোড়ের কাছে ব্রনফিল্ড রো-এর পরিত্যক্ত অফিসঘরে তখন কম করে জনা চল্লিশেক মহিলার ভিড়। তরুণী বধূ মাখদুমা আখতারি চোখ পাকিয়ে তাঁর দুই একরত্তি কন্যেকে হুটোপাটি বন্ধ করে ‘লক্ষ্মী’ হয়ে বসতে বলেন। আর কিছু ক্ষণেই মেয়েদের ‘তারাবির নমাজ’ শুরু হবে। রাত ৮টার পরে এশার নমাজ শেষে বাড়তি কুড়ি রাকাত নামাজই হল তারাবির নমাজ।

কয়েক বছর ধরে রমজানে নাগরিক-কলকাতার এ-ও একটি রং। প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি পাড়াতে কোনও ফাঁকা ফ্ল্যাট, পরিত্যক্ত অফিসঘর, ক্লাব বা স্কুলবাড়িতে চোখে পড়ছে মেয়েদের এই জমায়েত। বাংলা সাহিত্যের কলেজশিক্ষিকা তথা সমাজকর্মী আফরোজা খাতুন বলছিলেন, ‘‘খুব ছোটবেলায় আমাদের মুর্শিদাবাদের গ্রামে বড়দের সঙ্গে ইদগাহে ইদের নমাজ দেখতে যাওয়ার অনুমতি মিলত। কিন্তু তার পরে বড় হয়ে বা চাকরি জীবনের গোড়াতেও মেয়েদের মসজিদে গিয়ে বা জামাতে (দলবদ্ধ হয়ে) নমাজ পড়তে বিশেষ দেখিনি! খুব ভাল লাগছে যে ছবিটা পাল্টাচ্ছে।’’ তাঁর চোখে, ‘‘মেয়েদের ধর্মপালনের অধিকারটুকুর এই স্বীকৃতিও জরুরি। মেয়েরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নমাজের আগে-পরে নানা মত বিনিময়ের মধ্যেও একটা গত-ভাঙা ইতিবাচক দিক আছে।’’

রমজানে মসজিদে সান্ধ্য নমাজ শেষে একসঙ্গে উপবাসভঙ্গ বা ইফতার করার মধ্যে এমনিতে পুরুষদের পারস্পরিক মেলামেশার একটা মঞ্চ গড়ে ওঠে। কিন্তু অন্তঃপুরবাসী বেশিরভাগ মেয়েরই দিন-রাত কাটে গেরস্থালির কাজে। মাঝরাতে উঠে পরিবারের সব উপবাসরত রোজাদারদের জন্য ‘সেহরি’ রান্না করা থেকে তাঁদের দিন শুরু। এর পরে ইফতার বা তার পরের খাবারের বন্দোবস্তও করতে হয়। পুরুষরা তাও সন্ধ্যায় ধর্মাচরণের ফাঁকে এক সঙ্গে জড়ো হওয়ার অবকাশ পান। যা সচরাচর মেয়েদের ভাগ্যে জোটে না।

অনেকেই তারাবির নমাজ চলাকালীন টানা কয়েক দিন ধরে গোটা কোরান আবৃত্তি করেন। বারবার উঠে দাঁড়িয়ে বা মাটিতে হাঁটু গেড়ে কুড়ি রাকাত নমাজ পড়ার মধ্যে ৪০ বার মাটিতে প্রণামের ভঙ্গিতে মাথা ঠেকিয়ে ‘সেজদা’ করাও দস্তুর। শনিবার মোমিনপুরে চোখে পড়ল, বারবার ওঠা-বসা করতে অসমর্থ বয়স্ক মহিলাদের জন্য কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। সামনে সারিবদ্ধ হয়ে আরও অনেকে নমাজ আদায়ে এসেছেন। সাহিত্যিক-অধ্যাপক শামিম আহমেদ বলছিলেন, ‘‘মক্কার কাবাতে কিন্তু মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গেই নমাজ পড়েন। কলকাতায় মেয়েরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে তারাবির নমাজ পড়ার মতো ইদানীং গ্রামবাংলায় নানা জায়গাতেই মেয়েদের একত্রে জুম্মার বা ইদের নমাজ পড়তেও দেখা যাচ্ছে।’’

কলাবাগানের মাঠে প্যান্ডেল খাটিয়ে বা রাজাবাজারের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে রমজানে মেয়েদের তারাবির নমাজ বা কোরান-পাঠের ধুম। ১০-১৫ দিন বা গোটা মাস ধরেই কেউ কেউ কোরান পড়ছেন। শনিবার রোজার ১৯তম দিনে মোমিনপুরে ছিল কোরান পড়ার শেষ দিন। তারাবির নমাজের আগেই আলাপ হল স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পুরোধা আব্দুল রবের সঙ্গে। বললেন, ‘‘শুধু ছেলেরা ধর্মের নিয়ম মানবে, আর মেয়েরা বাড়ি-বন্দি হয়ে থাকবে, তা কি হয়!’’ আব্দুল সাহেবের স্ত্রী হুসনেআরা বেগম দুপুর থেকে সকলের জন্য হালিম রান্না করে এনেছেন।

নমাজ শুরুর আগে গল্প করছিলেন একদা ফরোয়ার্ড ব্লক কর্মী প্রৌঢ়া মুন্নি বেগম এবং পাড়ার দুই তরুণী বধূ সাবিনা আলি, আফরোজারা। সাবিনা বলছিলেন, ‘‘বাড়িতে নমাজ পড়া বা কোরান পাঠের বাইরে এই সবার সঙ্গে মেলামেশায় একটা আলাদা আনন্দ! কত জনের সঙ্গে দেখা হয়। পাড়ার অনেককেই আমি ভাল চিনতাম না। এখন বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Women Namaz Freedom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE