Advertisement
E-Paper

চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারল পাড়া

শেষ পর্যন্ত দমদম থানা মামলা রুজু করে তদন্তের কাজ শুরু করেছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ০১:৫৯
এলাকায় পড়ে নিগৃহীত যুবকের দেহ। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

এলাকায় পড়ে নিগৃহীত যুবকের দেহ। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

প্রথমে মাটিতে ফেলে এলোপাথাড়ি লাথি আর ঘুসি। তার পরে বাতিস্তম্ভে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে চলল গণপিটুনি। দক্ষিণ দমদমের চাষিপাড়ায় এই ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, ‘‘বাঁশ থেকে লোহার রড— যে যা দিয়ে পেরেছে, মেরেছে।’’ বেধড়ক মারধরের পরে চোর সন্দেহে ধরা গুরুতর জখম যুবকটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে আসা হল ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরে, এক নির্মাণস্থলে। অজ্ঞাতপরিচয় ওই যুবকের চিকিৎসা করানোর জন্য কেউ তৎপর হলেন না। তাই সেখানেই গোটা পাড়ার চোখের সামনে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যু হল তাঁর। পাড়ার কেউ অবশ্য পুলিশে খবর দেওয়ারও কোনও প্রয়োজন বোধ করলেন না। অমানবিকতার প্রদর্শনে পিছিয়ে থাকেনি পুলিশও। মৃতদেহটি উদ্ধারের পরিবর্তে ওই জায়গা কাদের এলাকায় পড়ছে, তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় দুই থানা, দমদম ও লেক টাউনের টানাপড়েন। শেষ পর্যন্ত দমদম থানা মামলা রুজু করে তদন্তের কাজ শুরু করেছে।

মঙ্গলবার সকালের এই ঘটনায় দ্বিধাবিভক্ত দক্ষিণ দমদম পুরসভার ময়রাবাগান ও বসাকবাগানের বাসিন্দারা। নমিতা মণ্ডল, রঞ্জন দাস, স্বপ্না মুখোপাধ্যায়দের বক্তব্য, ‘‘চুরি করলে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারত। এ ভাবে মারবে কেন? যে মায়ের কোল শূন্য হল, তাঁকে ছেলে ফিরিয়ে দিতে পারবে?’’ অন্য দিকে, কোন পরিস্থিতিতে গায়ে হাত তোলা হয়েছে, সেই মারের মাত্রা কেমন ছিল, তা নিয়ে আলোচনাতেই ব্যস্ত রইলেন পূর্ণিমা দাসেরা। ঘটনাচক্রে, পূর্ণিমার বাড়িতেই ওই যুবক চুরির চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ। পূর্ণিমা জানান, প্রতিদিন ভোর ৪টে নাগাদ উঠে তিনি বাড়ির কাজ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়ি তৈরির জন্য লোহার রড, জিআই পাইপ মজুত করা ছিল। সেই রড কেউ টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরেই ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করতে থাকি।’’ মায়ের হাঁকডাকে ঘুম থেকে উঠে পড়েন পূর্ণিমার দুই ছেলে রঞ্জন ও অঞ্জন এবং তাঁদের প্রতিবেশী বাচ্চু সীট। তিন জন তিন দিক দিয়ে ওই যুবককে ঘিরে ফেলেন। রঞ্জনের কথায়, ‘‘ওই যুবকের সঙ্গে আরও তিন জন ভ্যান নিয়ে এসেছিল। তারা পালালেও নেশাগ্রস্ত হওয়ায় ওই যুবক পালাতে পারেনি।’’

মারধরের বিবরণ দিতে গিয়ে রঞ্জন বলেন, ‘‘মিথ্যা বলব না, সবাই মিলে ওকে মারধর করা হয়েছে। অনেক ছেলে এসেছিল। আমাদের বাড়ির সামনে মারধরের পরে বাতিস্তম্ভে বাঁধা হয়। তবে বাঁশ বা রড দিয়ে কেউ মারেনি। হাত দিয়ে মেরেছে।’’ রঞ্জন যখন এ কথা বলছেন, তখন গলির অন্য প্রান্ত থেকে তাঁর বয়ানের প্রতিবাদ করে নমিতা বলেন, ‘‘বাঁশ, রড দিয়েই মেরেছে। কত করে সবাই বললাম, মারিস না। কারও কানে কথা গেল না। এক জন করে এসে মারছে, আর হাসছে। ছেলেটার মাথার পিছন থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। দুটো হাত থেঁতো করে একেবারে ফুলিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা কাহিল হয়ে পড়েছিল।’’ সেই দৃশ্যের কথা স্মরণ করে বাসন্তী প্রামাণিক নামে এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘বললাম, আর মারিস না। পুলিশে খবর দে। কেউ শুনল না।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নমিতা জানান, সকাল সাতটা পর্যন্ত মারধরের পরে ওই যুবককে তিন জনে মিলে নির্মাণস্থলের সামনে ফেলে আসেন। সেই বক্তব্যে সম্মতি জানিয়ে আর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘‘ওই যুবককে রক্তাক্ত অবস্থায় প্রথমে এক জনের বাড়ির সামনে রেখে দিয়েছিল। উনি চিৎকার করলে ময়রাবাগানের নির্মাণস্থলে ইটের স্তূপের পাশে ওকে রেখে আসা হয়।’’ স্বপ্না মুখোপাধ্যায় নামে এক মহিলা বলেন, ‘‘সকালে ছেলেকে স্কুলে দিতে গিয়ে দেখি, এক যুবক হেলান দেওয়া অবস্থায় বসে রয়েছে। কিছু ক্ষণ পরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু হাঁটতে না পেরে বালির স্তূপের মধ্যে পড়ে গেল।’’ এর পরেই কোনও এক সময়ে ওই যুবক সেখানে মারা যান বলে অনুমান। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত কেউ উদ্ধার করতে আসেনি তাঁকে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় দমদম ও লেক টাউন থানার পুলিশ। স্থানীয় সূত্রের খবর, ঘটনাস্থল কোন থানার অন্তর্গত, তা নিয়ে পুলিশকর্মীদের মধ্যে শুরু হয় টানাপড়েন। এর পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওই যুবককে মৃত ঘোষণা করা হয়।

এ দিন গণপিটুনির এই ঘটনায় বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত এক জনকে বাতিস্তম্ভে বেঁধে পেটানো হল। অথচ, পুলিশ তা জানতে পারল না কেন? অভিযুক্তদের না খুঁজে দুই থানা এলাকা ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেন? সর্বোপরি, মার খাওয়া যুবক ধুঁকছেন দেখেও তাঁর সাহায্যে এলাকার কেউ এগিয়ে এলেন না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই নিজের মতো অজুহাত খাড়া করেছেন। বাসিন্দাদের বক্তব্য, ওই যুবকের যে এই পরিণতি হবে, তা তাঁরা বুঝতে পারেননি!

পুলিশি টানাপড়েন প্রসঙ্গে বিধাননগর কমিশনারেটের বক্তব্য, যেখানে মারধর করা হয়েছে, সেটি দমদম থানার অন্তর্গত। দেহটি যেখানে পড়ে ছিল, সেটিও দমদম থানার এলাকা। তাদের প্রশ্ন, লেক টাউন থানার এলাকাই যদি হবে, তা হলে দমদম থানা দেহ নিল কেন? এই বিতর্কে ইতি টেনে সন্ধ্যায় ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সুনীলকুমার চৌধুরী বলেন, ‘‘ঘটনাস্থল দমদম থানারই অন্তর্গত। মামলা রুজু করে তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে।’’

প্রশাসনিক টানাপড়েনে ইতি পড়লেও অমানবিক ওই ঘটনা কার ওয়ার্ডে ঘটেছে, তা নিয়েও দুই তৃণমূল কাউন্সিলর একে অপরের কোর্টে বল ঠেলেছেন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুনমুন চট্টোপাধ্যায় এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য, দু’জনেই এই ঘটনায় যুক্ত লোকজন তাঁদের ওয়ার্ডের নয় বলে দাবি করেছেন।

Lynching Dum Dum
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy