অম্বিকেশ-কাণ্ডে পূর্ব যাদবপুর থানায় দাখিল করা জেনারেল ডায়েরি (জিডি)-র অসঙ্গতি নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ কলকাতা হাইকোর্টের। সেই জিডি’র বয়ান দেখে বৃহস্পতিবার অ্যাডভোকেট জেনারেলের উদ্দেশে বিচারপতি বলেন, “এ সব কী হচ্ছে!”
ঘটনার মূলে একটি রঙ্গচিত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র যেটি এক বন্ধুকে ‘ফরওয়ার্ড’ করেছিলেন নিজের সমবায় আবাসনের ই-মেল থেকে। সেটা ২০১২-র ১২ এপ্রিলের কথা। অভিযোগ: ব্যঙ্গচিত্রটির মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতে কালি ছেটানো হয়েছে এই যুক্তিতে সে দিন রাতেই স্থানীয় তৃণমূলকর্মীরা অম্বিকেশবাবুর উপরে চড়াও হয়ে তাঁকে মারধর করে। পুলিশ অম্বিকেশবাবু ও নিউ গড়িয়ার সমবায় আবাসনের সভাপতি সুব্রত সেনগুপ্তকে গ্রেফতার করে। থানায় দীর্ঘক্ষণ তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়। রাত বারোটার পরে দু’জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে পুলিশ মহিলার সম্মানহানি ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে অশ্লীল ছবি পাঠানো-সহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে। রাতটা লক-আপে রেখে পর দিন পুলিশ তাঁদের কোর্টে তোলে। কোর্টে অবশ্য ওঁরা জামিন পেয়ে যান।
রাজ্য জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। পুলিশ তখন দাবি করে, হামলাবাজির খবর পেয়ে তারা অম্বিকেশবাবুদের উদ্ধার করতে গিয়েছিল। কিন্তু দু’জনকে কেন রাতে লক-আপে রাখা হল, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি পুলিশ। মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত তদন্ত করে রাজ্যকে সুপারিশ করে, অম্বিকেশবাবু ও সুব্রতবাবুকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। সে-রাতের ঘটনায় যুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিক প্রশাসন। রাজ্য কোনওটাই মানেনি। ক্ষতিপূরণের সুপারিশ কার্যকর না-হওয়ায় অম্বিকেশবাবু হাইকোর্টে মামলা করেন। এ দিন তারই শুনানিতে পুলিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। কী রকম?
ওই রাতে পূর্ব যাদবপুর থানায় অম্বিকেশবাবুদের বিরুদ্ধে যে জিডি করা হয়েছিল, অম্বিকেশবাবুর কৌঁসুলি বিকাশ ভট্টাচার্য আদালতে সেটি পড়ে শোনান। বিকাশবাবু বলেন, জিডি-র ১১ নম্বর পাতায় লেখা রয়েছে, কী ভাবে পুলিশ অম্বিকেশবাবু ও তাঁর পড়শি সুব্রত সেনগুপ্তকে গ্রেফতার করেছিল। অথচ ১২ নম্বর পাতায় সে বিবরণ শেষ হওয়ার আগেই ব্যঙ্গচিত্রে উল্লিখিত ‘মুকুল’ ও ‘ভ্যানিশ’-এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে! শুনে বিচারপতির প্রশ্ন, “এটা কী ধরনের জিডি? এগারো নম্বর পাতার সঙ্গে বারো নম্বরের এমন অসঙ্গতি কেন?”
সরকারপক্ষের কাছে কার্যত এর জবাব ছিল না। জিডি-র আরও কিছু বয়ান সম্পর্কেও আদালত প্রশ্ন তুলেছে। যেমন জিডি’তে লেখা হয়েছে, সুব্রতবাবু গ্রেফতার হওয়ার পরে পুলিশকে বলেছিলেন, তিনি বাড়ি যেতে চান না, বরং থানাতেই তিনি অনেক বেশি সুরক্ষিত বোধ করছেন। বিকাশবাবুর দাবি, সুব্রতবাবুর মুখে কথাগুলো বসানো হলেও আদতে তা লিখেছেন পূর্ব যাদবপুর থানার ওসি সুধীর মিশ্র। বিচারপতিও বলেন, “ওই সব বক্তব্যের রেকর্ড কোথায়? এ তো মনে হচ্ছে, সুব্রত সেনগুপ্তর হয়ে ওসি নিজে লিখে দিচ্ছেন!”
অন্য দিকে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, অম্বিকেশবাবু বা সুব্রতবাবু কখনও অভিযোগ করেননি যে, তাঁদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়েছিল। পুলিশ তাঁদের হেনস্থা করেছে, এমন কথাও ওঁরা কখনও বলেননি। এই সমস্ত অভিযোগ মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তুলেছে বলে জানান এজি। তাঁর এই যুক্তি শুনে বিচারপতির মন্তব্য, “এ সব কী হচ্ছে!” এই সময়ে রাজ্য সরকারের তরফে হাইকোর্টের কাছে আবেদন করা হয়, জেনারেল ডায়েরি (জিডি) না-দেখে কেস ডায়েরি (সিডি) দেখা হোক। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি বলেন, কেস ডায়েরি দেখলেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যা শুনেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আদালত। “কোনটা আগে লেখা হয়?” প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি। আদালতের বক্তব্য, জিডি-র অনেক পরে সিডি লেখা হয়। তাই জিডি থেকেই ঘটনার প্রথম বিবরণ পাওয়া সম্ভব।” মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী সপ্তাহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy