Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আনন্দ আর বেদনার সবটুকুই সয়ে নেয় আমার এই শহর

চল্লিশের দশকের অনেক আগে থেকেই আমি উত্তর কলকাতার বাসিন্দা। ওখানকারই স্কুলে পড়াশোনা। প্রতি দিন ভোরে রাস্তা ধোওয়া দেখে ভাবতাম কলকাতা ঘুম থেকে জেগে উঠল। প্রতি দিন সন্ধেবেলা আমাদের বাড়ির সামনের গ্যাস বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে যেত কলকাতা কর্পোরেশনের একটি লোক। হাল্কা আবছা আলোয় মনে হত এই শহরের প্রাণ বুঝি নতুন করে জেগে উঠল। আরও মনে হত, যদি একা এই রাতে এই শহরটা একবার চক্কর দিয়ে আসতে পারতাম! কিন্তু তার তো কোনও উপায় নেই।

পরান বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৭
Share: Save:

চল্লিশের দশকের অনেক আগে থেকেই আমি উত্তর কলকাতার বাসিন্দা। ওখানকারই স্কুলে পড়াশোনা। প্রতি দিন ভোরে রাস্তা ধোওয়া দেখে ভাবতাম কলকাতা ঘুম থেকে জেগে উঠল। প্রতি দিন সন্ধেবেলা আমাদের বাড়ির সামনের গ্যাস বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে যেত কলকাতা কর্পোরেশনের একটি লোক। হাল্কা আবছা আলোয় মনে হত এই শহরের প্রাণ বুঝি নতুন করে জেগে উঠল। আরও মনে হত, যদি একা এই রাতে এই শহরটা একবার চক্কর দিয়ে আসতে পারতাম! কিন্তু তার তো কোনও উপায় নেই। কড়া শাসনের কারণে বাড়ির বাইরে বেশি পা রাখা বারণ। তবে, বাড়ির বড়দের সঙ্গে মাঝে মধ্যে বেড়াতে যেতাম জাদুঘর বা চিড়িয়াখানায়। কখনও সিনেমা বা ম্যাজিক দেখতেও যেতাম। কখনও বা ফেরার পথে আমেনিয়ার বিরিয়ানি ও চাপ। এ যেন এক অন্য কলকাতা। কত দিন হয়েছে সকালের কোচিং ক্লাস পালিয়ে নেত্র-তে মর্নিং শো দেখেছি। বাবার দেওয়া হাতখরচা বাঁচিয়ে পাঁচ আনা টিকিটের লাইনে দাঁড়ানোর উত্তেজনা এখনও ভুলতে পারি না!

পঞ্চাশের দশকের কলেজ জীবন ঘিরে নানা রোমাঞ্চ আমাকে এখনও উত্তেজিত করে তোলে! ফেলে আসা দিন আর ফিরবে না! কিন্তু সেই সময়ের আনন্দ এখনও আমার সব কাজকেই প্রেরণা দেয়। নিষেধের সব বেড়া ডিঙিয়ে দামাল মনে যেন কলকাতায় দাপিয়ে বেড়ানো। টকি শো হাউসে ইংরেজি ছবি দেখার পর মনে হত আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। আর কফি হাউসের আড্ডা? নাটক এবং কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে সে সব দিনের তর্ক এখনও কানে ভাসে। এমনকী, বন্ধুদের সঙ্গে হাতাহাতিও মনে আছে।

কিশোর বয়স থেকেই নাটক আমার প্রাণ। পাড়ায় মাচা বেঁধে নাটক হত। বড়রা খুবই উৎসাহ দিতেন। কিন্তু, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরি জীবনের পাশাপাশি ছিল থিয়েটার। তখন তো থিয়েটার মানেই সব উত্তরে। স্টার, রঙমহল, বিশ্বরূপা, মিনার্ভা সবই। এখনও মনে পড়ে শ্যাম স্কোয়্যারে আয়োজিত বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের নাটকের কথা। অনুভূতিটাই আলাদা। তখন তো রাত জেগে মহাজাতি সদনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরেও হাজির থাকতাম। পর দিন ভোরবেলায় হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। এমনই মজা পেতাম দুর্গাপুজোর সময়। অষ্টমীর রাতে পায়ে হেঁটে পুরো কলকাতার ঠাকুর দেখা, ফুচকা খাওয়া আর দু’পায়ে ফোস্কা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ি ফেরা। তখন তো কলকাতায় ‘থিম’ পুজো হত না। সাবেকি পুজো। একচালার ঠাকুর। মাটির ভাঁড়, আখের ছিবড়ে, বাদামের খোলার মতো থিম না থাকলেও তখন কলকাতার সব পুজোই সেরা পুজো হত। পুজো আসার অপেক্ষাতেই দিন গুনতাম। কারণ, বছরের ওই ক’টা দিনই যে বড় স্বাধীন থাকতাম। আর সেই স্বাধীনতার অর্থ কলকাতার রাজপথে বীর বিক্রমে সিগারেটে টান দেওয়া।

আমি ছোটবেলা থেকেই বড্ড হুজুগে ছিলাম। ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান যখন মুখোমুখি হত, তার আগের দিন থেকেই আমার ঘুম যেত উবে। খাওয়াদাওয়াও বন্ধ হয়ে যেত। খেলা শেষে মানুষের ঢল কলকাতা জুড়ে। শহরের অলিগলিতে আলোচনা আর তর্ক। এই শহরের সবাই বড় খেলা-পাগল। টিকিট না পেলে গাছের ডালে ঝুলে খেলার দেখার অনুভূতি আমারও আছে। গাছে যত না পাতা, তার চেয়েও বেশি মানুষ ঝুলছে ডাল আঁকড়ে।

তবে, থিয়েটারকেই বেশি ভালবেসে ফেলেছিলাম। তখন তো থিয়েটার মানে বিরাট ব্যাপার। কে কোন থিয়েটার দেখেছে, কে দেখেনি এই সব নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে লড়াই চলত। সত্যি কথা বলতে, ষাটের দশকে কলকাতায় থিয়েটারের রমরমা ছিল। এক একটি হলের সামনে দীর্ঘ লাইন। টিকিট না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরা। তখন তো গ্রুপ থিয়েটার আর কমার্শিয়াল থিয়েটার পাশাপাশি চলত। আমার তো তখন ব্যস্ত জীবন। এক দিকে, চাকরি। অন্য দিকে, নাটক বা রিহার্সাল। সারা দিনে কোনও সময় নেই। তারই ফাঁকে খিদে পেলে নবীনচন্দ্রের রসগোল্লা, বাগবাজারের তেলেভাজা, দ্বারিক ঘোষের লুচি— এখনও স্মৃতিকে নাড়া দেয়। যে স্মৃতি মনকে কেমন উদাস করে দেয়।

এমন উদাস এখনও হই। তবে সেটা বড় বিষাদের। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন কলকাতা শহরে আর যে তেমন ‘ভো-কাট্টা’ শুনতে পাই না। নবাবি ঘুড়ি পেল্লায় ডানা মেলে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেত। এখন সে সব কোথায়? আসলে কালের নিয়মে যুগের চাহিদায় কলকাতার সব কিছুই বদলে যেতে থাকে। মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিং, উড়ালপুল, বড় বড় কমপ্লেক্স এই শহরের সবুজকে যেন চুরি করে নিয়েছে। রাস্তার দু’ধারের কৃষ্ণচূড়ারা হারিয়ে গিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সর্বংসহা নীলকণ্ঠ গঙ্গার কাছে পাঠ নিয়ে এই ম্যাজিক কলকাতার রাজপথ কত ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে— বেদনা, কষ্ট, বিচ্ছেদ সবই রয়েছে তাঁর ভাণ্ডারে। আত্মঘাতী দাঙ্গা, পুলিশের গুলি, রক্তাক্ত রাজপথে লক্ষ পায়ের দৃপ্ত মিছিল। কোনওটা আনন্দের, গর্বের, মিলনের। পদ্মা-গঙ্গা উৎসব, বইমেলা, শিল্পমেলা, পুষ্পমেলা, নাট্যমেলা, গানমেলা আরও কত ভার বইতে পারে এই আমার কলকাতা।

বাঁচার দাবিতে, জীবনের জয়গানে, প্রতিবাদের মঞ্চে, অনাহারী গৃহহীন ক্লান্ত দিনের শেষে প্রতি ক্ষণেই স্নেহময়ী মায়ের আঁচলই আমার কলকাতা।

লেখক: অভিনেতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

paran banerjee paran bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE