আমার বাবা-মা দু’জনেই সুচিত্রা মিত্রের বন্ধু ছিলেন। শান্তিনিকেতনে মায়ের সঙ্গে একই হস্টেলে থাকতেন। সেই সুবাদে তিনি আমার সুচিত্রা মাসি। নিয়মিত যে ওঁর কাছে গান শিখেছি তেমনটা নয়। কখনও কখনও ফোন করে বলতাম, “তোমার কাছে আসব?” উত্তর আসত, “না আসবি না। আমি ফাঁকা নেই।” অথবা, “চলে আয়।” গিয়ে একই দিনে তিন-চারটি গান তুলে আনতাম মাসির কাছ থেকে। ওঁকে যেমন শ্রদ্ধা ও সমীহ করতাম, তেমন ভয়ও পেতাম। আমার সমস্ত আবদারও ছিল তাঁর কাছে। ভীষণই ভালবাসতেন আমাকে। বলতেন, “গানের ভেতরে ঢুকে গাও। সেটার জন্য একটা মননশীলতা লাগে। গানের মর্মবাণীর মধ্যে তলিয়ে যেতে হয়। তা হলেই তুমি একাত্ম হতে পারবে।” গানকে ‘ফ্যাশন’ নয়, সর্বদা ‘প্যাশন’ বানানোর কথা বলতেন মাসি।
এখনকার প্রজন্ম তো মাসির শেষের দিনগুলি দেখেছে, যখন তিনি সত্যিই খুব অসুস্থ। আমি ওঁকে ওঁদের যৌবনে দেখেছি। আমাদের বাড়িতে তখন গানের আসর বসত। মাসি কখনও গুনে গান গাইতেন না। একটানা ৩০-৩৫টা গান গেয়ে যেতেন। গাইবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। গলা বাঁচিয়ে গান তিনি গাইতেন না। মনে আছে, ষাটের দশকের শেষের এক লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতের কথা। বাড়িতে আসর বসেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। মাসি একের পর এক গেয়ে চলেছেন। কী আড়ম্বরহীন! মাইক নেই। কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ নেই। ভোরের দিকে শেষ করলেন ‘আমার রাত পোহাল’ দিয়ে। স্মৃতিতে আজও আছে সেই কণ্ঠ এবং গায়কী।
রবীন্দ্রনাথের গানের মাধ্যমেই তিনি জীবনের উত্তরণের পথ খুঁজে পেতেন। গানের পাশাপাশি ছড়া লিখতেন। ছবি আঁকতেন। রান্নাও করতেন বেশ পরিপাটি করে। নিজের হাতে পুতুল গড়তেন মাসি। অসম্ভব সময়ানুবর্তিতা ছিল ওঁর। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি যথেষ্ট স্নেহশীল ছিলেন। ১৯৭৫ সালের একটা ঘটনার কথা জানি। সে বছর প্রায় পঁচিশ জনের একটি দল নিয়ে সুচিত্রা মাসির মার্কিন মুলুকে যাওয়ার কথা ‘তাসের দেশ’ নিয়ে। সমস্ত প্রস্তুতি যখন শেষ, হঠাৎই এই সফরে যিনি অর্থ দিয়ে সাহায্য করছিলেন তিনি বেঁকে বসেন। অথচ গোটা দল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। যাতায়াত খরচের অঙ্কটাই বিরাট। একে তো এত টাকার ধাক্কা, তায় শেষ সময়ে কে-ই বা এই টাকাপয়সার দায় নেবে! মাসি নিলেন। ব্যাঙ্কে নিজের সমস্ত গয়না বন্ধক দিয়ে তিনি টাকার ব্যবস্থা করলেন। এতগুলো ছেলেমেয়েকে কথা দিয়েছেন যে। তারা নিরাশ হবে, এটা তিনি মানতে পারছিলেন না। এই হল তাঁর ‘কমিটমেন্ট’। পরে যদিও ভারত সরকারের অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। তবে সেটা সফর শেষে দেশে ফেরার পর। টাকা ফেরত পাবেন জেনে তিনি কিন্তু গয়না বন্ধক দেননি। অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন।
মাসির একটা কথা খুব মনে পড়ে, তিনি বলতেন, “জানিস, ট্রেনে জন্মেছিলাম বলে গতি আমার রক্তে। থামা আমার কুষ্টিতে নেই।” কিন্তু সেই উদ্যমী মানুষটিও এক দিন থেমে গেলেন। ভাবলেই খুব কষ্ট হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy