Advertisement
E-Paper

টাকা নেই, সারানো যাচ্ছে না জীর্ণ বাড়ি

হাজার দুয়েক বাড়ির সামনে ‘বিপজ্জনক’ নোটিস লটকে রাখা আছে। এর মধ্যে কখনও কখনও ভেঙেও পড়ছে জীর্ণ বাড়ির একাংশ। ঘটনায় কেউ হতাহত হলে খবর হয়। তদন্ত কমিটি বসে। তার পরে সব ধামাচাপা পড়ে যায়। জীর্ণ বাড়ির সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের বাড়িগুলি ঘুরে দেখলেন অশোক সেনগুপ্ত।এক সময়ে কলকাতার মেয়র হিসেবে জীর্ণ বাড়ি নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছিল গোবিন্দচন্দ্র দে-কে। তাঁর চিন্তা ছিল, জীর্ণ বাড়ি ভেঙে হতাহতের ঘটনা যেন না ঘটে। প্রায় ৪৬ বছর বাদে তাঁর পুত্র সুজয় দে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পৈতৃক বাড়ি নিয়ে। কখন, কোন অংশ ভেঙে বিপত্তি হয় দুশ্চিন্তা তা নিয়েই। কিন্তু বাড়ি সারানোর উপায় নেই। সুজয়বাবুর অভিযোগ, ‘ভাড়াটেদের অসহযোগিতা’ও বাড়ি সংস্কার না হওয়ার অন্যতম কারণ। আর একটা কারণ অর্থাভাব।

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০২:৪৬
বিধান সরণি

বিধান সরণি

এক সময়ে কলকাতার মেয়র হিসেবে জীর্ণ বাড়ি নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছিল গোবিন্দচন্দ্র দে-কে। তাঁর চিন্তা ছিল, জীর্ণ বাড়ি ভেঙে হতাহতের ঘটনা যেন না ঘটে। প্রায় ৪৬ বছর বাদে তাঁর পুত্র সুজয় দে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পৈতৃক বাড়ি নিয়ে। কখন, কোন অংশ ভেঙে বিপত্তি হয় দুশ্চিন্তা তা নিয়েই। কিন্তু বাড়ি সারানোর উপায় নেই। সুজয়বাবুর অভিযোগ, ‘ভাড়াটেদের অসহযোগিতা’ও বাড়ি সংস্কার না হওয়ার অন্যতম কারণ। আর একটা কারণ অর্থাভাব।

শুধু সুজয়বাবুর বাড়িই নয়, বেশির ভাগ জীর্ণ বাড়ি সংস্কার না হওয়ার অন্যতম কারণ এই দু’টিই। পাশাপাশি রয়েছে বাড়ির মালিকানা নিয়ে শরিকি বিবাদ এবং নানা আইনি জটিলতা। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, বিধান সরণির ১১৪/২এ এবং ২বি-র বাড়িটির কথা। ১৯৩০ সালে সাড়ে ছ’কাঠারও বেশি জমির উপর তৈরি তিনতলা বাড়িটি পড়ে আছে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। বাড়ির একাংশে গোবিন্দচন্দ্রবাবু এক সময়ে একটি হাসপাতালের ছাত্রদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর পুত্র সুজয় দে বলেন, “স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রশান্ত শূর ছাত্রাবাসটি তুলে দেন। বাড়িটির অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে বাড়িটি মেরামতির জন্য পুরসভা নোটিস দিয়েছিল। কিন্তু আমি অসহায়। এই বুঝি কোনও অংশ ভেঙে পড়লসেই ভেবে রাতে ঘুম হয় না।”

বাড়িটির নীচে রয়েছে চারটি দোকান। বাড়িটি সংস্কারের ব্যাপারে কী বলছেন ভাড়াটে দোকানিরা? তাঁদের পাল্টা অভিযোগ, বহু যুগ ওই বাড়ির কোনও রকম রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। তাঁদের প্রশ্ন, ব্যবসা চালু রেখে বাড়িওয়ালা মেরামতি করলে ক্ষতি কোথায়? সুজয়বাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “বাড়ি থেকে এক পয়সা আয় নেই। উল্টে বছরে ১২ হাজার টাকা পুরকর গুনতে হচ্ছে। মেরামতির টাকা পাব কোথায়?” এই চাপান-উতোরে বাড়ির মেরামতি বিশ বাঁও জলে।

আর জি কর রোড

বি টি রোড-এর ভাঙাচোরা বাড়িগুলি।

প্রায় একই রকম আতঙ্কে বাস করছেন গ্যালিফ স্ট্রিটের ট্রামডিপোর পিছনে ১৪/এ দুর্গাদাস চ্যাটার্জি লেনের বাড়ির একাংশের মালিক সূর্যকান্ত দত্তর। স্বাধীনতার আগে তৈরি বাড়িটি তাঁর দাদু কেনেন ১৯৫৫ সালে। এক চিলতে জমির উপর চারতলা বাড়ি। ঘরের সংখ্যা সাত। কার্নিশের চাঙড় ভেঙে পড়ছে মাঝেমধ্যেই। বহুকাল অযত্নে, অবহেলায় পড়ে আছে বাড়িটি। কেন সারান না? সূর্যবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “কী ভাবে সারাব? যৎসামান্য ভাড়া। তা-ও ২০০২ থেকে বন্ধ।”

শ্যামবাজারের কাছে ১৩ মোহনলাল স্ট্রিটের প্রায় ৮৪ বছরের পুরনো বাড়ির অবস্থাও বেহাল। দোতলার মেঝে ফেটে যাচ্ছে। ভেঙে পড়ার আশঙ্কা যে কোনও সময়ে। কেন মেরামতি করাচ্ছেন না? বাড়ির মালিক শিবপুর দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ভাইস প্রিন্সিপাল বিষ্ণু ঘোষ বলেন, “১৯৪২ সালে যিনি ভাড়া নিয়েছিলেন, তাঁর উত্তরাধিকারী বাড়ি তালাবন্ধ করে অন্যত্র চলে গেলেও ফ্ল্যাট ছাড়ছেন না। ভাড়াও পাই না। মেরামতের সুযোগ কোথায়?” ওই ভাড়াটে হিমাদ্রি বিশ্বাস কাজ করেন একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার অভিযোগটা ঠিক নয়। মাঝেমধ্যে এই বাড়িতে থাকি। মালিক ভাড়া নিতে চান না। তাই এখন রেন্ট কন্ট্রোলে জমা দিচ্ছি।” কত টাকা ভাড়া? হিমাদ্রিবাবু জানান, তিন ঘরের ফ্ল্যাটের জন্য মাসে দেন ৫১ টাকা।

এই সব উদাহরণ থেকে স্পষ্ট, জীর্ণ বাড়ি সারানোর জন্য টাকা খরচকে অপব্যয় বলেই ভাবছেন বাড়ির মালিকেরা। এক জীর্ণ বাড়ির মালিক বলেন, “এর চেয়ে যদি বাড়ি ভেঙে পড়ে যায়, বরং কিছুটা লাভ হবে। অন্তত জমিটা বিক্রি করতে পারব।”

তা হলে কি এই সমস্যার কোনও সমাধান নেই? গৃহমালিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুকুমার রক্ষিত অবশ্য এর জন্য দুষছেন সরকারের ভূমিকাকেই। তিনি বলেন, “এক দিকে নামমাত্র ভাড়া। অন্য দিকে, ক্রমবর্ধমান পুরকর ও আনুষঙ্গিক খরচ। বাড়িভাড়া আইন সংশোধিত হওয়া সত্ত্বেও সরকার তা রূপায়ণে উদ্যোগী হচ্ছে না। নিষ্পত্তি হচ্ছে না ঝুলে থাকা কয়েক হাজার মামলার।” তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করানোর কথা বলা হয়েছে। এই অবস্থায় ‘না-ভোটে’ বোতাম টিপে ভোটাধিকার প্রয়োগে বাড়ির মালিকদের আর্জি জানাল গৃহমালিক সংগঠনের যৌথ মোর্চা।

সমস্যাটা কোথায়? ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের প্রধান সচিব এ কে সিংহ বলেন, “এ সব বিষয় নিয়ে আমরা সম্প্রতি বিভাগীয় স্তরে আলোচনা করেছি। জটিলতা রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। যেগুলোর সমাধান সম্ভব, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করব।” দফতর সূত্রের খবর, কলকাতা, আলিপুর ও শিয়ালদহ আদালতে বাড়িভাড়া মামলা শুনানির জন্য রয়েছেন মাত্র এক জন রেন্ট-কন্ট্রোলার। সেই সংখ্যা বাড়ানোর কথা হচ্ছে।

বাড়ি কেন বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে থাকবে? এ ব্যাপারে পুরসভাই বা কতটা সক্রিয়? মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ভাড়াটেদের রেখেই যাঁরা জীর্ণ বাড়ি নতুন করে বানাতে চান, পুর আইন শিথিল করে তাঁদের বাড়তি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।”

কী ভাবে মিলছে এই পুর-সুযোগ? বিল্ডিং বিভাগের ডিজি অনিন্দ্য কারফর্মা বলেন, “বাড়িটির যেটুকু অংশে ভাড়াটে থাকেন, নতুন বাড়ির নকশায় সেটুকুর জন্য বাড়তি ছাড় মঞ্জুর হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বাড়িতে ক’জন ভাড়াটে কতটা জায়গা নিয়ে আছেন, বিল্ডিং কমিটির বৈঠকে তা খতিয়ে দেখে তবেই ঠিক হয় ছাড়ের পরিমাণ।” পুরসভার দাবি, ২০০৯ সালে সুযোগটি কার্যকরী হলেও প্রথম দিকে সাড়া মেলেনি। এখন প্রতি মাসে ৮-১০টি বাড়ির মালিক এ সুযোগ নিচ্ছেন।

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ashok sengupta decayedhouse kolkata corporation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy