Advertisement
E-Paper

দু’টুকরো যক্ষ মূর্তি, আঠা দিয়ে ইতিহাস জোড়ার চেষ্টা জাদুঘরে

অশোকের আমলের রামপূর্বা সিংহের পরে এ বার কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ভেঙে গেল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের একটি যক্ষ মূর্তির পায়ের পাতা। তড়িঘড়ি করে সেই অংশটি আঠা দিয়ে আটকে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। জাদুঘরের ভারহুত গ্যালারির ঢোকার মুখেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশের সাতনার বৌদ্ধ প্রত্নস্থল ভারহুত থেকেই পাওয়া যক্ষ-যক্ষিনীর মূর্তি। ডান দিকে রয়েছে যক্ষের মূর্তিটি এবং বাঁ দিকে যক্ষিনীর। মূর্তিটি লাল বেলে পাথরের তৈরি।

অলখ মুখোপাধ্যায় ও দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
ভাঙা অংশ জোড়া লাগানোর চেষ্টা হয়েছে আঠা দিয়ে।

ভাঙা অংশ জোড়া লাগানোর চেষ্টা হয়েছে আঠা দিয়ে।

অশোকের আমলের রামপূর্বা সিংহের পরে এ বার কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ভেঙে গেল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের একটি যক্ষ মূর্তির পায়ের পাতা। তড়িঘড়ি করে সেই অংশটি আঠা দিয়ে আটকে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।

জাদুঘরের ভারহুত গ্যালারির ঢোকার মুখেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশের সাতনার বৌদ্ধ প্রত্নস্থল ভারহুত থেকেই পাওয়া যক্ষ-যক্ষিনীর মূর্তি। ডান দিকে রয়েছে যক্ষের মূর্তিটি এবং বাঁ দিকে যক্ষিনীর। মূর্তিটি লাল বেলে পাথরের তৈরি।

ভারতীয় পুরাতত্ত্বে ভারহুতের গুরুত্ব কতটা? ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা অধিকর্তা গৌতম সেনগুপ্ত জানান, ভারতীয় পুরাতত্ত্বে কাহিনিধর্মী শিল্পকলার প্রাচীনতম নিদর্শন মেলে যে ক’টি মাত্র কেন্দ্র থেকে, তার অন্যতম ভারহুত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতী রায় জানান, মধ্য ভারত এবং উত্তর ভারতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম একটি প্রাণকেন্দ্রও ছিল ভারহুত। বৌদ্ধ দর্শনের ক্রমবিবর্তনের রূপও ভারহুতের স্থাপত্যে ধরা রয়েছে। যেমন গৌতমবাবু জানান, যক্ষ যে বৌদ্ধ ধর্মাচরণে স্থান পাচ্ছে, তা ভারহুতের স্থাপত্যেই প্রথম বোঝা যায়। সেই ভারহুতের সব থেকে বড় সংগ্রহ রয়েছে কলকাতা জাদুঘরেই। ১৮৭৩ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম ভারহুতের বৌদ্ধ প্রত্নস্থল আবিষ্কার করেন। পরের বছর উত্‌খননের পরে প্রত্ন নিদর্শনগুলি সযত্নে সংরক্ষণের জন্য কলকাতায় জাদুঘরে এনে রেখেছিলেন। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, জাদুঘর এখন তার নিজের গর্ব নিজেই নষ্ট করছে।

অভিযোগ, তিন-চার দিন আগেই যক্ষের মূর্তিটির ডান পায়ের পাতাটি ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ তা জানতেন না। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের সচিব রবীন্দ্র সিংহের পরিদর্শনের মুখে বুধবার জাদুঘরেরই এক গ্রুপ-সি কর্মী তাড়াহুড়ো করে আঠা দিয়ে ভেঙে যাওয়া অংশটি জোড়া লাগাতে গেলে সব কথা ফাঁস হয়ে যায়। ওই গ্রুপ-সি কর্মী এক তরুণী ইন্টার্নকে অপমান করাতেই বিষয়টি জানাজানি হয়। খবর পৌঁছয় জাদুঘরের শিক্ষা-আধিকারিক সায়ন ভট্টাচার্য এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মিতা চক্রবর্তীর কাছে। মিতাদেবী এই মুহূর্তে পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান। তিনি জাদুঘরের সংগ্রহশালার দায়িত্বেও রয়েছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আঠা লাগানোর কাজে বাধা দেন। কিন্তু পায়ের ভাঙা অংশ না লাগানো হলেও, মূর্তির ডান পায়ের কাছে থাকা বিবরণের প্লেট খুলে ফেলেছেন ওই গ্রুপ-সি কর্মী।

এর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মৌর্য যুগে অশোকের আমলের সিংহ মূর্তিটি সরাতে গিয়ে ভেঙে যায়। তার পরেও বারবার জাদুঘরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, গাফিলতি, উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় সচিবের পরিদর্শনের মুখে এ দিন জাদুঘর খোলার আগেই কর্তৃপক্ষের একাংশের পরোক্ষ মদতেই সকালবেলা ওই কর্মী এই কাণ্ড করতে গিয়েছিলেন বলে অনুমান জাদুঘরের কর্মীদের একাংশের। তবে এ দিনের ঘটনা নিয়ে মিতাদেবী কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি জানান, এ বিষয়ে তাঁর কোনও কথা বলার অধিকার নেই। যা বলার মিডিয়া মুখপাত্র অশোক ত্রিপাঠী বলবেন। জাদুঘরের মিডিয়া অফিসার অশোক ত্রিপাঠী পুরো ঘটনাটিই অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “এ রকম কোনও ঘটনা ঘটেনি।”

জাদুঘরের ভেঙে যাওয়া সেই মূর্তি।

তবে জাদুঘরের অছি পরিষদের সদস্য অধ্যাপক শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, সংগ্রহালয়ের কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে ফের মূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন নষ্ট হল। তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে তদন্তের জন্য আমি অধিকর্তাকে চিঠি দেব।” ক্ষুব্ধ পুরাতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদরাও। জাদুঘরের প্রাক্তন অধিকর্তা অনুপ মতিলাল বলেন, “ঐতিহ্য রক্ষায় যথেষ্ট যত্নশীল নন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।” পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণবিদ পার্থ দাস জানান, যে ভাবে জাদুঘরে ভারহুতের স্থাপত্যগুলি রাখা হয়েছে, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কী ভাবে এই ভাঙা অংশ জোড়া লাগানো উচিত ছিল? তিনি বলেন, “খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের বেলে পাথরের মূর্তির কোনও অংশ ভেঙে গেলে তা জোড়া লাগানোর বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়া রয়েছে। তা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমেই ব্যবহার করা উচিত। এ ভাবে আঠা দিয়ে যেমন-তমন ভাবে তা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করাটাই মূর্খামি।” সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, মূর্তিটি যে ভেঙে গিয়েছিল এবং পরে জোড়া লাগানো হয়েছে, তা লুকোনও উচিত নয়।

কিন্তু কী করে যক্ষের মূর্তির পায়ের পাতা ভাঙল, তার কোনও ব্যাখ্যা জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এ দিন দিতে পারেননি। জাদুঘরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সুমন্ত্র রায় এই মুহূর্তে কলকাতার বাইরে। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তিন দিন ধরে বাইরে রয়েছি। তাই কিছু জানি না।” জাদুঘরের অধিকর্তা বি বেনুগোপালের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়। কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

alakh mukhopadhyay deeksha bhunia indian museum broken statue
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy