এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না খবরটা। আবার একই সঙ্গে মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে পরিবারের পুরনো দুর্ঘটনার স্মৃতি। পর মুহূর্তেই অবশ্য সামলে নিচ্ছেন নিজেকে। বলছেন, “আশা করি ভগবান এতটা নিষ্ঠুর হবেন না আমাদের প্রতি।”
তিনি কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়। মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের হারিয়ে যাওয়া বিমানের বাঙালি যাত্রী মুক্তেশ মুখোপাধ্যায়ের কাকা। ছয় ভাইয়ের মধ্যে মিলনবাবুই সবার ছোট। তাঁর সেজদাদা মলয় মুখোপাধ্যায়ের ছেলে মুক্তেশ। শনিবার দুপুরে বিমান উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা শোনার পর থেকেই ছটফট করছেন বছর ষাটেকের প্রৌঢ় মিলনবাবু। সল্টলেকের বাড়িতে বসে ভগবানকে ডাকছেন শুধু। ইচ্ছে ছিল, রবিবারই বেজিং চলে যাবেন মুক্তেশের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। কিন্তু ভিসা পেতে দেরি হল। এ দিন ভিসা পেয়েছেন। আজ, সোমবার বেজিং রওনা হচ্ছেন মিলনবাবু।
১৯৭৩ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এক বিমান দুর্ঘটনাতেই মারা গিয়েছিলেন মুক্তেশের দাদু মোহন কুমারমঙ্গলম। সেই স্মৃতিই এখন তাড়া করছে মুখোপাধ্যায় পরিবারকে। ইন্দিরা গাঁধীর ঘনিষ্ঠ কুমারমঙ্গলম বিয়ে করেছিলেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের ভাগ্নী কল্যাণী মুখোপাধ্যায়কে। ১৯৭১-’৭২ সালে কেন্দ্রে ইস্পাতমন্ত্রী হন তিনি। ১৯৭৩ সালের ৩০ মে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নামার আগে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের যে বিমানটি ভেঙে পড়ে, তার যাত্রী ছিলেন মোহন। মোহন আর কল্যাণীর মেয়ে উমাই মলয়বাবুর স্ত্রী, মুক্তেশের মা। তবে মুক্তেশের ভাগ্যে দাদুর মতো কিছু ঘটেনি বলে আশায় বুক বেঁধে আছেন মিলনবাবুরা। মালয়েশিয়ার বিমানটির ধ্বংসাবশেষ এখনও মেলেনি। সেটাই গোটা পরিবারের আশার কারণ।
মিলনবাবুর কাছ থেকেই জানা গেল, মুক্তেশ নিজে কলকাতায় ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরে ভিলাইয়ের ডিপিএস-এ ভর্তি হন। কানাডায় উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মুক্তেশ ছিলেন বিআইটি মেসরা-র ছাত্র। তিনি এখন কানাডারই নাগরিক। মন্ট্রিয়লে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পরে আর্সেলর মিত্তলে যোগ দেন। মুক্তেশের বাবা মলয়বাবুও ছিলেন আর্সেলর মিত্তলে। মুক্তেশের দাদা এখনও আর্সেলর মিত্তলে কর্মরত।
আর্সেলর মিত্তলের কর্মী হিসেবেই বছর দশেক আগে বেজিংয়ে যেতে হয়েছিল মুক্তেশকে। সেখানেই জিয়াওমো বাই-এর সঙ্গে পরিচয় তাঁর। মুক্তেশের অফিসে অনুবাদকের কাজ করতেন চিনের মেয়ে জিয়াওমো। তাঁকে বিয়ে করার পর মুক্তেশ পাকাপাকি ভাবে বেজিংয়ে থাকতে শুরু করেন। কিছু দিন আগে আর্সেলর মিত্তল ছেড়ে তিনি একটি চিনা সংস্থায় যোগ দেন। ৪২ বছরের মুক্তেশ আর ৩৭ বছরের জিয়াওমো-র দুই ছেলে। মিরাভ (৭) ও মাইলস (৪)। মিলনবাবু বলছিলেন, “আমাদের পরিবারে ছেলেদের নাম রাখা হয় বাংলার ‘ম’ অক্ষর দিয়ে। সেই মতোই মুক্তেশের দুই ছেলের নাম হয়েছে।”
নিখোঁজ বিমানে মুক্তেশের সঙ্গেই ছিলেন জিয়াওমো। বেজিং ফিরছিলেন তাঁরা। সেখানে বাবা-মার জন্য অপেক্ষা করছে দু’ভাই। মিলনবাবু বলেন, “ওদের জন্য খুব মন খারাপ করছে।” শনিবার মুক্তেশের ব্যক্তিগত সচিব ফোন করে বাড়িতে দুর্ঘটনার খবর দেন। মলয়বাবু তখন লন্ডনে ছিলেন। খবর শুনেই তিনি দোহা চলে যান। মুক্তেশের দাদা রয়েছেন দোহায়। মা উমা বড় ছেলের সঙ্গেই আছেন। ওঁরা সকলেই এ দিন বেজিং গিয়েছেন।
মুক্তেশের সঙ্গে মিলনবাবুর শেষ দেখা ২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকায়। মিলনবাবু বলেন, “কাজের চাপে নিয়মিত দেশে আসতে পারত না। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে গিয়েছিলাম। ফাইনাল ম্যাচ একসঙ্গে দেখেছি।” ফোনে কথা হতো। সবাই সবার খবর রাখতেন। শনিবার যে খবরটা এল, সেটার জন্য অবশ্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। তবু আশা না ছেড়েই বেজিং যাচ্ছেন মিলনবাবু।