Advertisement
২১ মে ২০২৪
সব চেয়ে বড় বিশৃঙ্খলা

বেসামাল ভিড়ে বন্ধ দেশপ্রিয় পার্ক

‘বিশ্বের সব থেকে বড়’ বলে বড়াই করে বিজ্ঞাপন পড়েছিল ছ’মাস আগে। সেই দেশপ্রিয় পার্কের পুজো বাস্তবে শহরে সব থেকে বড় বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বসল পঞ্চমীতেই! দেশপ্রিয় পার্কে ভিড়ের জেরে রবিবার দুপুর থেকেই স্তব্ধ হয়ে যায় দক্ষিণ কলকাতার বড় একটি অংশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ল্যাজে-গোবরে হয়ে শেষে পুজোটাই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দিল পুলিশ।

তত ক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর দরজা। মণ্ডপের সামনে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ। রবিবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

তত ক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর দরজা। মণ্ডপের সামনে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ। রবিবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

‘বিশ্বের সব থেকে বড়’ বলে বড়াই করে বিজ্ঞাপন পড়েছিল ছ’মাস আগে। সেই দেশপ্রিয় পার্কের পুজো বাস্তবে শহরে সব থেকে বড় বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বসল পঞ্চমীতেই!

দেশপ্রিয় পার্কে ভিড়ের জেরে রবিবার দুপুর থেকেই স্তব্ধ হয়ে যায় দক্ষিণ কলকাতার বড় একটি অংশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ল্যাজে-গোবরে হয়ে শেষে পুজোটাই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দিল পুলিশ। সাধারণ মানুষ আপাতত ওই মণ্ডপে আর ঢুকতে পারবেন না। কবে ওই পুজো দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে বা আদৌ হবে কি না, রবিবার রাত পর্যন্ত তা জানায়নি লালবাজার। এমন পরিস্থিতির দায় কার? পুলিশ এবং পুজো উদ্যোক্তারা পরস্পরের উপরে দোষ চাপাতে ব্যস্ত। পুলিশ কমিশনারের দাবি, দেশপ্রিয় পার্কের ওই পুজো এ বার ঠিক কী আকার নেবে, সেটা নাকি পুলিশ জানতই না!


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

পুজোর ভিড় সামলে প্রতিবারই কৃতিত্বের দাবিদার হয় কলকাতা পুলিশ। লালবাজারের অনেক কর্তাই ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেন, পুজোর চার-পাঁচ দিন ধরে যে ভাবে ভিড় এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা, অন্যান্য রাজ্যের পুলিশের সে ক্ষমতা নেই। কিন্তু এ দিন যা ঘটল, তাতে কলকাতা পুলিশের সেই গর্বে অনেকখানি কালি লেগে গেল।

শহরের পুজোকর্তাদের অনেকে বলছেন, দেশপ্রিয় পার্কে ২০১৩ এবং ২০১৪ সালেও ভিড় বেশি হয়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছিল। এ দিন তা হলে যান চলাচল ভেঙে পড়ল কেন? লালবাজারের এক পুলিশকর্তার দাবি, পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল না। কিন্তু আচমকা ভিড় সামলাতে পুজো উদ্যোক্তাদের দিক থেকে যে সাহায্য প্রয়োজন ছিল, তা মেলেনি। দেশপ্রিয় পার্কের এক পুজোকর্তার পাল্টা বক্তব্য, ‘‘আমাদের খামতি থাকলে পুলিশেরও খামতি রয়েছে।’’ পুজো কমিটি নিয়ম নেমে মণ্ডপ বানায়নি, পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন নেয়নি বলে এখন অভিযোগ আনছে পুলিশ। সিপি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ নিজে বলেছেন, কমিটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন আইনের পথে চলবে। তবে তাঁর কথায়, ‘‘অনুমতি দেওয়া নিয়ে কার কার গাফিলতি ছিল, সেই বিতর্কে এখন ঢুকতে চাইছি না।’’

পুজোর জন্য দমকল ও পুলিশের অনুমোদন লাগে। লালবাজার জানাচ্ছে, তারা দমকলের রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করেই সংশ্লিষ্ট পুজো কমিটিকে অনুমোদন দেয়। দমকলের একটি সূত্রের খবর, তারা ওই মণ্ডপের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেগুলি মানা হয়েছে কি না, পরবর্তী কালে তা আর খতিয়ে দেখেনি তারা। এ দিন সিপি দাবি করেন, অনুমতি পাওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত মানেনি পুজো কমিটি। যদিও দেশপ্রিয় পার্কের পুজোকর্তা সুদীপ্ত কুমার নিয়ম ভাঙার অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, ‘‘সবাই যে ভাবে অনুমতি পেয়েছে, তেমনই আমরাও পেয়েছি। অনুমতি না পেলে এত বড় পুজো করা যায় নাকি!’’

প্রশ্ন হল— দীর্ঘ প্রচার এবং প্রস্তুতি নিয়ে যে মণ্ডপ বানানো হয়েছে, সেটার অনিয়ম পঞ্চমীর দিন কেন চোখে পড়ল পুলিশের? আশি ফুটেরও বেশি উঁচু মণ্ডপ দেখার জন্য বিপুল ভিড় হলে তা কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, তার আগাম পরিকল্পনাই বা ছিল না কেন? কমিশনারের বক্তব্য, এ দিনের ভিড় সব পরিকল্পনা ছাপিয়ে গিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। লালবাজারের অন্দরের খবর, শনিবার রাতেই বোঝা গিয়েছিল দেশপ্রিয় পার্ক নিয়ে ভুগতে হবে। কিন্তু সেটা যে পঞ্চমীতেই এই আকার নেবে, সেটা বোঝা যায়নি।

দেশপ্রিয় পার্কের পুজো নিয়ে এ বার বিজ্ঞাপনী প্রচার ছিল তুঙ্গে। জনমানসে ধারণা তৈরি হয়েছিল, এখানে বিশ্বের সব থেকে বড় দুর্গামূর্তি তৈরি হচ্ছে। বাস্তবে অবশ্য মণ্ডপটাই তৈরি হয়েছে একটি দুর্গামূর্তির আদলে। তৃতীয়ার রাত থেকেই ভিড় জমছিল গড়িয়াহাট এলাকায়। হচ্ছিল বিশৃঙ্খলাও। প্রতিবাদ করায় এক মহিলা শ্লীলতাহানির শিকার হন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এ দিনও ভিড়ের দাপটে এ দিন তিন জন দর্শনার্থী আহত হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট জমা হতে থাকে, কে কী ভাবে রাস্তায় আটকে পড়েছেন, তা-ই নিয়ে। ছড়াতে থাকে গুজবও। দেশপ্রিয় পার্ক বয়কট করার হ্যাশট্যাগ চালু হয়ে যায়। এক দিকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত যান চলাচল আর সেই সঙ্গে ভিড়ের চাপে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা— লালবাজার সূত্রের খবর, বিকেল পাঁচটা নাগাদ পুলিশ বুঝতে পারে অবিলম্বে কড়া পদক্ষেপ না করলে বড় বিপদ ঘটে যাবে। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পুজোর গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। খালি করে দেওয়া হয় মণ্ডপ। বিভিন্ন মোড় থেকে মাইকে দেশপ্রিয় পার্কমুখী ভিড়কে অন্য পুজো দেখতে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়। মেট্রো থেকেও একই কথা প্রচার করানো হতে থাকে। অবস্থা সামাল দিতে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। সব গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হয় অন্য রাস্তা দিয়ে।

এ দিনের ঘটনার পরে প্রবীণদের স্মৃতিতে ফিরে এসেছে পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দমকল পরিচালিত পুজোয় তখন দমকল কেন্দ্রের সামনে বিশাল দুর্গা প্রতিমা দর্শনের জন্য এক সময় পুরো রাস্তা বন্ধ রাখা হতো। তাতে ব্যাহত হতো বিভিন্ন জরুরি পরিষেবা। ১৯৬৫ সালে পুলিশ ও দমকল যৌথ ভাবে ওই পুজো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাম্প্রতিক কালে ২০০০ সালে বোসপুকুরের ভাঁড়ের মণ্ডপ দেখার ভিড়ের জন্য এক বার রাসবিহারী অ্যাভিনিউ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ ভিড় সামলাতে না পেরে পুজোমণ্ডপে মানুষকে ঢুকতে বারণ করে দিচ্ছে, এমন ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারেননি কেউই। পুলিশ কর্তাদের দাবি, কলেজ স্কোয়ার বা মহম্মদ আলি পার্কের মতো পুজোয় প্রতি বছর এমন ভিড় সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা পুলিশের আছে। কিন্তু সেখানে ফুটপাথে ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়। পুলিশের অভিযোগ, স্পনসরদের খুশি করতে গিয়ে দেশপ্রিয় পার্কের উদ্যোক্তারা পুলিশকে ব্যারিকেড বসাতে দেননি। তাতেই বিপদ ঘনিয়েছে বলে তাঁদের দাবি।

পুলিশ সূত্রেরই খবর, এ দিন যান চলাচলের বিপর্যয় এমন জায়গায় পৌঁছয় যে এসপ্ল্যানেড থেকে দ্রুত দেশপ্রিয় পার্কে পৌঁছতে পুলিশ কমিশনার-সহ লালবাজারের শীর্ষকর্তাদের মেট্রোয় চড়তে হয়! রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকে রিজেন্ট পার্ক থেকে টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পৌঁছে দিতে ট্রাফিক নিয়ম মানতে পারেননি পুলিশ অফিসারেরা! দেশপ্রিয় পার্কে পৌঁছে পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার পর সুরজিৎবাবু বলেন, ‘‘এত ভিড় সামাল দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। আমরা এমন কিছু হতে দেব না, যাতে মানুষের ক্ষতি হয়।’’ রাতে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র জানিয়ে দেন, আপাতত ওই পুজো দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকী রাস্তায় ভিড় জমিয়েও দেখা যাবে না ৮৮ ফুটের ওই মণ্ডপ। সিপি-ও পরে সাংবাদিক বৈঠক করে একই সিদ্ধান্ত জানান।

কিন্তু পরিস্থিতি এমন জায়গায় যাওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? সুরজিৎবাবু দাবি করেন, ওই মণ্ডপ ঠিক কী চেহারা নিতে চলেছে, সেটা তাঁরা জানতেন না। এবং ঠিক কতটা ভিড় জমতে পারে, সেটাও বোঝা যায়নি। অর্থাৎ পরিস্থিতি আঁচ করতে যে ভুল হয়েছিল, সেটা কার্যত মেনেই নেন তিনি। পুলিশের একাংশ মানছেন, কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ হল, ৪০ ফুটের বেশি উচ্চতার মণ্ডপ তৈরি করা যাবে না। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করেই ৮৮ ফুটের মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছিল। পুলিশ আটকায়নি কেন? যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, ‘‘পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিক বার উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল। এর থেকে বেশি কিছু বলব না।’’

প্রশাসন সূত্রের খবর, দেশপ্রিয় পার্কের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি মহলের দাবি, এমন পরিস্থিতি হতে পারে, আশঙ্কা করে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে সতর্কও করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে লালবাজারের এক কর্তা বলছেন, পরমা উড়ালপুলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। পুজোর আগে তড়িঘড়ি অসমাপ্ত উড়ালপুল খুলে দেওয়ায় যানজটে স্তব্ধ হয়েছিল কলকাতার একাংশ। শেষে দ্বিমুখী (টু-ওয়ে) যান চলাচলের বদলে একমুখী (ওয়ান-ওয়ে) যান চলাচল করিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা বাগে আনা গিয়েছে। ‘‘পুজোর আগে পরমা উড়ালপুল আর দেশপ্রিয় পার্ক, এই দু’টো বিষয় নিয়েই চর্চা শুরু হয়েছিল শহরে। বাস্তবে দু’টোই সুপার ফ্লপ হয়েছে,’’ মন্তব্য ওই কর্তার! তবে বড় কোনও বিপদ ঘটার আগেই যে এ দিন ব্যবস্থা নেওয়া গিয়েছে, সেটাই কিছুটা তৃপ্তি দিচ্ছে লালবাজারকে।

দেশপ্রিয় পার্কের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে শহরের বেশ কিছু পুজো কমিটি ভিড় সামাল দেওয়ার নতুন পরিকল্পনা করছে। একডালিয়া এভারগ্রিনের কর্তা তথা পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এ দিন পুলিশ একটা বার্তা পেয়েছে। আমাদের মণ্ডপেও প্রচুর ভিড় হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি আমরাও স্বেচ্ছাসেবক নামাচ্ছি।’’

পঞ্চমীর সন্ধ্যায় ব্যাপক ভিড়ে নাকাল হয়েছে উত্তর কলকাতা, মধ্য কলকাতা, বেহালা এবং দক্ষিণ শহরতলিও। দমদম পার্ক, সল্টলেক কিংবা বরাহনগরের মণ্ডপেও ছিল ঠাসাঠাসি ভিড়। অস্বাভাবিক ভিড়ে মেট্রো চলাচলেও বিঘ্ন ঘটেছে।

আজ, সোমবার মহাষষ্ঠী। পাঁজি মেনে পুজোর বোধন। উৎসবের ফাইনাল রাউন্ড শুরুর দিনে কেমন থাকে মহানগর, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE