Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মার্জিত দুই শিক্ষকের মাঝে দুই চ্যালেঞ্জারও

চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে কিং সাইজ সিগারেটে লম্বা টান দিচ্ছেন সৌগত রায়। উত্তর দমদমের কাঁদিহাটি অঞ্চল। রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বিধানসভা কেন্দ্রের ১৬ নম্বর ওয়ার্ড। কলকাতা বিমানবন্দরের পিছনের দিকে ওই অঞ্চলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের বাস। পাকা বাড়ি, ঢালাই রাস্তার মাঝে ভাঙাচোরা টালির চালে বাস করেন কিছু আদিবাসী মানুষও। বিকেল ৪টের ভ্যাপসা-পচা গরম।

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৪ ০২:৫১
Share: Save:

চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে কিং সাইজ সিগারেটে লম্বা টান দিচ্ছেন সৌগত রায়।

উত্তর দমদমের কাঁদিহাটি অঞ্চল। রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বিধানসভা কেন্দ্রের ১৬ নম্বর ওয়ার্ড। কলকাতা বিমানবন্দরের পিছনের দিকে ওই অঞ্চলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের বাস। পাকা বাড়ি, ঢালাই রাস্তার মাঝে ভাঙাচোরা টালির চালে বাস করেন কিছু আদিবাসী মানুষও। বিকেল ৪টের ভ্যাপসা-পচা গরম। শ’দুয়েক তৃণমূল সমর্থক তা-ও তত ক্ষণে ঝান্ডা হাতে হাজির। অনেকেই এসে সৌগতবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন। কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন ঠান্ডা জলের বোতল। সবাই কেমন উত্তেজিত! যেন বিজয় মিছিল বার হবে!

কী বুঝছেন? কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সৌগতবাবুর উত্তর: “মানুষ আমার সঙ্গে আছে। এর বেশি আর কী চাইতে পারি? প্রচার শুরু করার পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত কোথাও কেউ আমাকে বলেনি, ২০০৯ সালের জেতার পর থেকে আপনাকে এলাকায় দেখা যায়নি। ডাকলেও আসেননি। কাজ করেননি!” বললেন, “আমার বিরুদ্ধে আর যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের আমি বেশি নম্বর দিতে রাজি নই!”

কথা সেরে সৌগতবাবু চন্দ্রিমাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে হুড খোলা জিপে উঠে গেলেন। পরনে চেনা ধুতি-পাঞ্জাবি। হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “এলাকার উন্নয়নের জন্য, শান্তির জন্য আমাকে ভোট দিন। জোড়া ফুলে ছাপ দিন।” সন্ধ্যা হলেই দমদমের পাড়ায় পাড়ায় মাইকে শোনা যাচ্ছে সৌগতবাবুর রেকর্ড করা বক্তৃতাও।

সাতটা বিধানসভা নিয়ে দমদম লোকসভা কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা ১৩ লক্ষেরও বেশি। বিধানসভা ভোটের নিরিখে সব ক’টাতেই এগিয়ে তৃণমূল। তাই কিছুটা স্বস্তির ছাপ সৌগতবাবু-সহ তৃণমূলের নেতাদের চোখেমুখে। কিন্তু এক সময়ের শক্ত ঘাঁটির হাল একেবারে ছেড়ে দিতে নারাজ বামেরাও। তাই এ বার প্রার্থী হিসেবে তারা দাঁড় করিয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তকে। দল মনে করেছে, শিক্ষিত-স্বল্পবাক তৃণমূল নেতা হিসেবে পরিচিত সৌগতবাবুর বিরুদ্ধে অসীমবাবুই মোক্ষম চাল হতে পারেন। দমদম কেন্দ্রে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএমের নির্বাচনী প্রচারে পাঁচ বছর আগে সৌগতবাবু কংগ্রেস-তৃণমূলের জোটপ্রার্থী হিসাবে জিতেছিলেন ২০ হাজারের কিছু বেশি ভোটে। পরে বিধানসভা ভোটে অবশ্য সেই ব্যবধান প্রায় দু’লাখ ছুঁইছুঁই! তবু বামেরা মনে করছে, চতুর্মুখী লড়াইয়ে তৃণমূলকে বিপাকে ফেলা একেবারে অসম্ভব নয়!

নাগেরবাজার জোনাল কার্যালয় থেকে প্রচার শুরু করবেন অসীমবাবু। তাঁর জন্যও হুড খোলা জিপের ব্যবস্থা হয়েছে। অলিগলি ঘুরতে হবে। লাল ঝান্ডা হাতে সমর্থকেরাও হাজির। রাস্তার আশেপাশে জোড়া ফুলের সবুজ ফ্লেক্সগুলির মাঝে যেন লাল রঙের আঁকিবুঁকি। রীতিমতো তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষকে শাসক দলের ব্যর্থতা বোঝাচ্ছেন অর্থনীতির শিক্ষক। মূল বক্তব্য সারদা ও টেট কেলেঙ্কারি নিয়ে, সেই সঙ্গে রাজ্যের মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব। বললেন, “প্রচারে বেরিয়ে আমি অন্তত এটুকু বুঝতে পারছি, যাঁরা এক দিন আমাদের পাশ থেকে সরে গিয়েছিলেন, তাঁরা আবার ফিরে আসছেন। আমি তো সব জায়গায় বলছি, ভুল যেখানে হয়েছে, আর হবে না।”

এমনিতে মূলত পায়ে হেঁটেই প্রতি দিন প্রচার সারছেন। ৫-১০ কিলোমিটার রাস্তা কোনও ব্যাপারই নয় যেন! রাস্তার আশেপাশের মানুষ তাঁকে দেখে এগিয়ে আসছেন। কথা বলছেন। মা-বোন-ভাই ছাড়া সিপিএম প্রার্থীর মুখে অন্য কোনও সম্বোধন নেই। বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কোনও আক্রমণ নেই। দমদম কেন্দ্রের অধিকাংশ সিপিএম নেতার বক্তব্য, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ অসীমবাবুকে চেনেন। দীর্ঘ দিন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। পাশাপাশি এই কেন্দ্রে তাঁর প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীও রয়েছে। ভোট-ব্যাঙ্কে তাঁদের প্রভাব থাকবেই বলে দলের আশা।

গত তিন বছর ধরে দমদমের সর্বত্র তৃণমূল এমন বীর বিক্রমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে যে, অন্য দলগুলির অস্তিত্ব বিশেষ চোখে পড়েনি সাধারণ মানুষের। তাই নির্বাচন ঘোষণার পরে সিপিএমের অনেক নেতারই মনে সংশয় ছিল, তৃণমূলের দাপটে দলীয় সমর্থকদের নিয়ে প্রচারে বেরোনো যাবে তো! গত তিন-চার বছরে দলের সক্রিয় সদস্য-সমর্থকদের মনোবল অনেকটাই ভেঙে গিয়েছে। সিপিএমের অসংখ্য ছোট ছোট কার্যালয় বন্ধ। ছুটির দিনে পার্টি অফিসের সামনে কমরেডদের আড্ডা মারতে দেখা যায় না। নিচুু তলার অনেক কর্মীই তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। এমতাবস্থায় প্রচারের শক্তি জোগাড় করতেই প্রথম দিকে বারবার ভাবতে হয়েছে সিপিএমের স্থানীয় নেতাদের। তবে অসীমবাবুর কথায়, “বরাহনগরে মিছিল করতে গিয়েই দেখলাম, লোকে আমাদের দিকে আসছেন। বিশেষ করে এক মহিলার কথা মনে আছে, যিনি এগিয়ে এসে বলেছিলেন, আপনারা আসুন। তা হলে শান্তি আসবে।”

অন্য সুরও কি নেই? বহু মানুষই তো বলছেন, সিপিএমের মিছিলে ঘুরেফিরে সেই পুরনো মুখগুলোই! অনেকেই মানছেন, শাসক দলের অন্দরে কোনও কোনও নেতার মধ্যে মন কষাকষি থাকলেও দমদমে তৃণমূল নির্বাচনী প্রচারে, লোকবলে এবং সাংগঠনিক জোরে অনেকটাই এগিয়ে। দলের অন্দর মহলেও প্রশ্ন রয়েছে, ভোটের দিন সব বুথে তাঁরা এজেন্ট দিতে পারবেন তো! নাগেরবাজার অঞ্চলের সিপিএম নেতা তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য পল্টু দাশগুপ্ত যদিও দাবি করলেন, “হাতে হাত মিলিয়ে সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে ভোটের দিন পর্যন্ত লড়তে পারলে দমদমে আমরা জিতছি!”

বিরোধীদের এ সব কথায় অবশ্য আমল দিচ্ছেন না দমদমের বিধায়ক তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। সৌগতবাবুকে নিয়ে নিজের কেন্দ্রে প্রচার থেকে ফিরে কালিন্দির বাড়িতে বসে বললেন, “শুধু আমার কেন্দ্র থেকেই সৌগতদা অন্তত ২০ হাজারের লিড পাবেন!” বিরোধীরা আবার পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, যদি এতই নিশ্চিন্ত হবেন সৌগতবাবু, তা হলে বরাহনগরে কর্মিসভায় কৌশলে বুথ দখলের ডাক দিতে হয়েছিল কেন!

দমদমের লড়াইটা অতএব এ বার সৌগতবাবু বনাম অসীমবাবুর বলেই ধরে নিয়েছে আম জনতা। তা বলে বিজেপি-র প্রার্থী তপন শিকদার আর কংগ্রেস প্রার্থী ধনঞ্জয় মৈত্র কি নেই কোথাও? নাহ্, এমনটা বললে সত্যের অপলাপ হবে!

তপনবাবু পরপর দু’বার জেতা সাংসদ। অশক্ত শরীর নিয়ে এ বার প্রচার কিছুটা আলগা হলেও মনের দিক থেকে একই রকম চনমনে। আশায় আছেন, ভোট শান্তিপূর্ণ হলে এ বারও ম্যাজিক দেখাবেন! সকালে কেষ্টপুর থেকে প্রচার শুরু করার মুখে গাড়িতে বসেই দাবি করলেন, সৌগতবাবু নির্বাচনে জেতার পরে জেশপ-সহ দমদমের একাধিক রুগ্‌ণ ও বন্ধ কারখানার পুনরুজ্জীবনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কণামাত্র কাজে ফলেনি! বললেন, সিপিএমের করুণ অবস্থা। সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলও প্রবল চাপে। সঙ্গে মোদী-হাওয়া তো রয়েছেই। দমদমে শুধু সিপিএম বনাম তৃণমূলের লড়াই এমন সহজ সমীকরণ শুনলে তাই মুচকি হাসছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।

ময়দানে আছে কংগ্রেসও। দলীয় মহলে ভদ্রলোক, সুবক্তা হিসেবে পরিচিত ‘শক্তিদা’ (ধনঞ্জয়) বসেছিলেন দমদম ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ে। সঙ্গে ভোটযুদ্ধের সেনাপতি, কংগ্রেসের উত্তর ২৪ পরগনার সভাপতি তাপস মজুমদার। তাপসবাবু বললেন, “লড়াইটা কাকে বলে, কংগ্রেস এ বার দমদমে দেখিয়ে দেবে!” ভোট কাড়তে ধনঞ্জয়বাবুর হাতিয়ার দমদম, পানিহাটি, কামারহাটিতে শিল্পের দুর্দশা। তাঁর কথায়, “দমদমে কংগ্রেসের প্রচুর সমর্থক রয়েছেন। এটা বড় ফ্যাক্টর।”

ভোটে নেমে জেতার আশা সব দলই করে। কিন্তু দমদমের ইতিহাস সত্যিই বলছে, এ কেন্দ্রে ওলটপালট হওয়াটা বিরল নয়! তত্‌কালীন লালদুর্গ দমদমে পরপর দু’বার প্রায় দেড় লক্ষের ব্যবধানে জিতেছিলেন তপনবাবু। তারও আগে ১৯৮৪ লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা-সহানুভূতির প্রবল হাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসের আশুতোষ লাহার জয় অনেকের মনে ‘বিস্ময়’ জাগিয়েছিল। জল তো এ বারও ঘোলা! ভোট কাটাকুটির বাজারে তাই উন্মুখ হয়ে আছেন সব দলের কর্মীরাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE