Advertisement
E-Paper

আদালতে বিস্ফোরক কুণাল

তাঁকে বরাবর ‘সততার প্রতীক’ বলে প্রচার করে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি এ দিন সারদা থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তুললেন কুণাল ঘোষ। দশ মাসের কারাজীবনে বারবার কিছু বলতে চেয়েও পারেননি তৃণমূলের এই সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ। এমনকী, আদালতে গোপন জবানবন্দি দিতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৯
এ দিন। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪। আদালতের বাইরে কুণাল ঘোষ। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

এ দিন। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪। আদালতের বাইরে কুণাল ঘোষ। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

তাঁকে বরাবর ‘সততার প্রতীক’ বলে প্রচার করে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি এ দিন সারদা থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তুললেন কুণাল ঘোষ।

দশ মাসের কারাজীবনে বারবার কিছু বলতে চেয়েও পারেননি তৃণমূলের এই সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ। এমনকী, আদালতে গোপন জবানবন্দি দিতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। শনিবার সিবিআই আদালতে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে সেই না-বলা কথাই চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন একদা মমতা-ঘনিষ্ঠ কুণাল ঘোষ, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আমার ও সুদীপ্ত সেনের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হোক।”

কেন তিনি এই কথা বলছেন, আদালতে থেকে ফেরার পথে তার ব্যাখ্যা দিয়ে কুণাল বলেন, “সারদা মিডিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা যদি সব থেকে বেশি কেউ পেয়ে থাকেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”

সারদা কেলেঙ্কারি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১৩ সালের এপ্রিলে। তার পর থেকে প্রায় দেড় বছরের মধ্যে মমতার দিকে এ ভাবে সরাসরি আঙুল তোলার ঘটনা অভূতপূর্ব। খোদ মমতাই দাবি করেছিলেন, এই কেলেঙ্কারি সামনে আসার আগে তিনি সারদা নিয়ে কিছুই জানতেন না। অথচ সম্প্রতি জানা যায়, মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস সংস্থার ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছিল। এর পরেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় জানিয়ে দেন, চুক্তির সময় তিনি বা দীনেশ রেলমন্ত্রী ছিলেন না। তাঁর এই বক্তব্য ইঙ্গিতপূর্ণ হলেও সেখানে কোথাও সরাসরি তৃণমূল নেত্রীর নাম তোলা হয়নি। এ দিন মুকুল ছিলেন বসিরহাটের প্রচারসভায়। সেখানে কুণালের মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন, “এ বিষয়ে যা বলার তৃণমূল ভবনে বৈঠক করে বলা হচ্ছে।” সে দিক থেকে এ দিন কুণালই প্রথম সরাসরি চ্যালেঞ্জ করলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। যা শুনে বিরোধীরা বলেছেন, “নিজেকে সর্বদা সততার প্রতীক বলে দাবি করা মুখ্যমন্ত্রী কুণালের প্রস্তাব গ্রহণ করে নিজেকে প্রমাণ করুন!”

মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে এর মোকাবিলা করছেন? শুক্রবারই তিনি পাল্টা আঙুল তুলেছিলেন মিডিয়ার একাংশের দিকে। অভিযোগ করেছিলেন, সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তাঁর দল ও সরকারের বিরুদ্ধে এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম মিথ্যা প্রচার করছে। এ দিন কুণালের বিস্ফোরক মন্তব্যের পরে তিনি আর মুখ খোলেননি। তবে তাঁর মন্ত্রীরা জবাব দিতে ময়দানে নেমে পড়েছেন। শনিবার তৃণমূল ভবনে বসে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, “কুণাল ঘোষ দশ মাস জেলে। তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁর শাস্তি হবেই। তাই খড়কুটোর মতো মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখে বাঁচার চেষ্টা করছেন।” রাতে আবার এর পাল্টা জবাব দিয়েছেন কুণাল “আমার এত দুরবস্থা হয়নি!” মমতার হয়ে ব্যাট ধরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, “কুণাল ঘোষ একটা অপরাধী। একটা লোক জেল থেকে কী বলল, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করাটা অন্যায়।” এর পরে তিনি এ দিনও জোর গলায় বলেন, “তিনি (মমতা) সততার প্রতীক। তিনি কোনও অন্যায় করেননি। করতে পারেন না।” বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে উপনির্বাচনের প্রচার সভা থেকে সৌগত রায় বলেন, “কুণালের কথার দাম সাংবাদিকদের কাছে থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের কাছে নেই। আমরা ওকে অনেক দিন আগেই দল থেকে বহিষ্কার করেছি।”

দলের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, কুণালের এই বিবৃতির পরে শুধু সংবাদমাধ্যমকে নিশানা করে আর ‘সব মিথ্যা’ বলে চিৎকার করলেই হবে না। বিশেষ করে তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সারদা যোগের কথা জোর গলায় জানিয়েছেন, যে ভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তার পরে ‘মমতা সততার প্রতীক’ এই বলে গলা ফাটালে মানুষের কাছে তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সে নিয়ে সংশয় রয়েছে।

বিরোধীদের অবশ্য এ নিয়ে সংশয় নেই। মমতা সততার প্রতীক তৃণমূলের এই প্রচারকে কুণাল যে ভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন, তাতে ভুল দেখছেন না বিরোধী নেতারা। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর যদি সৎ সাহস থাকে, তা হলে কুণালের প্রস্তাবে রাজি হবেন। কিন্তু উনি সেই সাহস দেখাবেন কি?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যদি সততার প্রতীক হন, তা হলে তাঁরই দলের সাংসদ কুণাল ঘোষের দাবি মেনে সিবিআইয়ের মুখোমুখি হোন।” বিজেপি নেতা তথাগত রায় বলেছেন, “কুণাল ঘোষ কী এমন সাগর-ছেঁচা মানিক যে সারদা মিডিয়ায় তাঁকে ১৬ লক্ষ টাকা মাইনে দেওয়া হতো? সেই বেতন তো মমতাই ঠিক করে দিয়েছিলেন। এখন তাঁর কথা মানতে সমস্যা কোথায়?” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর উচিত কুণাল ঘোষের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা।

তা হলে রাজ্যের মানুষ সত্য জানতে পারবেন।”

আদালতে কুণালও সেই দাবিই করে এসেছেন। সারদার কয়েক হাজার কোটি টাকা কার মাধ্যমে কার কার কাছে পৌঁছেছে, সেই সত্য সামনে আনতে তিনি যে কোনও তদন্তের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত বলে আগেই জানিয়েছেন। তাই তিনি যে সুদীপ্ত সেনকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মুখোমুখি বসতে চান, এ দিন আদালতের কাছে সেই প্রস্তাবই রেখেছেন কুণাল।

তৃণমূলে কুণালের উত্থান অনেকটা উল্কার মতো। এক সময় সোমেন মিত্রের আস্থাভাজন কুণাল পরে প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ হন। গত দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি তৃণমূল নেত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তেও ঢুকে পড়েন। তৃণমূলের অন্দরের খবর, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে সরকার গঠনের সময় থেকে মমতার খুব পছন্দের পাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। অনেকের মতে, দল ও প্রশাসনের বহু সিদ্ধান্তে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূণর্র্ হয়ে উঠেছিল। তৃণমূলের প্রবীণদের মধ্যে এই নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হলেও তখন মমতা তাকে বিশেষ আমল দেননি।

প্রশাসনের একাংশের মতে, কুণালের মাধ্যমেই দলনেত্রীর কাছে পৌঁছন সারদাকর্তা। তাঁদের মধ্যে কালিম্পঙের ডেলোতে বৈঠকের কথা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন কুণালই। এমনকী, সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পরেও সংবাদপত্রকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এবং ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে দলের কর্মিসভায় কুণালকে আড়াল করার চেষ্টাই করেছেন তিনি। পরে সেই কুণাল যখন সোমেন মিত্রের পাড়ায় এক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তখন তাঁকে ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করতে সময় নেননি নেত্রী। প্রথমে কুণালকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়। তার পর তাঁকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। এ দিন পার্থ বা ফিরহাদের মতো তৃণমূল নেতারা কুণালকে ‘অপরাধী’ তকমা দিতেও পিছপা হননি। জবাবে কুণাল বলেছেন, “পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যদি হিম্মত থাকে, তা হলে বলুন পার্টিতে তদন্ত কমিশন (সারদা নিয়ে) হল না কেন?” কুণালের চ্যালেঞ্জ, “সৎ সাহস থাকলে পার্টি নেতাদের আমার সামনি-সামনি জেরায় বসানো হোক।”


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

যে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের সঙ্গে আইআরসিটিসি-র যোগ নিয়ে মমতার দিকে প্রথম আঙুল ওঠে, সেই সংস্থার একটি মামলাতেই কুণালকে হেফাজতে চেয়ে আদালতে আর্জি জানিয়েছিল সিবিআই। সেই শুনানিতে সিবিআই আদালতে এসে বিচারক অরবিন্দ মিশ্রের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ জানান, তিনি সিবিআই হেফাজতেই যেতে চান। কেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি বসার প্রসঙ্গ টেনে আনেন তিনি।বিচারকের কাছে তাঁর আরও আর্জি, অনেকেই সিবিআই তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। তাঁরা যাতে ঘর গোছাতে না পারেন, সে ব্যাপারেও তদন্তকারীদের সচেষ্ট হোন।

সারদা রিয়েলটির মামলায় কুণালকে আগে জেরা করেছে সিবিআই। এ দিন কুণাল আদালতে জানান, তিনি সারদার ওই সংস্থার ডিরেক্টর বা শেয়ার হোল্ডার ছিলেন না, সংস্থার কোনও নথিতে তাঁর সই করার অধিকারও ছিল না। কুণালের আরও বক্তব্য, এই মামলায় তিনি ৮৪ দিন বিচারাধীন বন্দি। কিন্তু এখনও চার্জশিট জমা পড়েনি। তবু তিনি জামিনের আর্জি জানাবেন না। কারণ, এই মামলাতেও তিনি সিবিআইয়ের হেফাজতে যেতে চান। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা জানান, সম্প্রতি সারদা ট্যুরস ও ট্রাভেলসের তদন্তে নেমে সারদার সংবাদমাধ্যম ব্যবসায় তাদেরই পর্যটন ব্যবসার টাকা বিনিয়োগের কথা জানা গিয়েছে। সেই সূত্রেই কুণালকে জেরা করা হবে বলে সিবিআই সূত্রের খবর।

এ দিন বেলা দেড়টা নাগাদ কুণালকে সিবিআই আদালতে হাজির করানো হয়। সেখানে সিবিআইয়ের আইনজীবী জানান, সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস বাজার থেকে তোলা টাকা বেঙ্গল মিডিয়ায় বিনিয়োগ করেছিল। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারদার এই সংস্থা বাজার থেকে ১২৫৯ কোটিরও বেশি টাকা তুলেছিল। ওই টাকা তোলা হয়েছিল বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে। এর মধ্যে ৯৮৮ কোটি টাকা আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হয়নি। আদালতে সিবিআইয়ের অভিযোগ, টাকা সরানোর ব্যাপারে যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র হয়েছিল, কুণাল তার অন্যতম সঙ্গী। তাই কুণালকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চায় তারা। আদালত সেই আর্জি মেনে কুণালকে সাত দিন সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

সারদা রিয়েলটির মামলায় এ দিন সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের জামিনের আর্জি জানিয়েছিলেন তাঁদের আইনজীবীরা। কিন্তু সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে জামিনের বিরোধিতা করা হয়। আদালত সুদীপ্ত ও দেবযানীকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সিবিআই আদালতে কুণালের মামলাটি ফের উঠবে ১২ সেপ্টেম্বর।

kunal burst out at court saroda cbi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy