সিবিআইয়ের দফতরে। বুধবার।—নিজস্ব চিত্র।
হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন। ক’দিন পরে কাশ্মীর থেকে কয়েকজন সঙ্গীসমেত ধরা পড়েন তিনি। বহিষ্কৃত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের দাবি, এই উধাও হওয়ার বিষয়টি ছিল নাটক। পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, তৃণমূলের উপরতলা থেকেই সুদীপ্তকে কিছু দিন দূরে কোথাও থাকতে বলা হয়েছিল বলে তাঁর ধারণা। সুদীপ্ত উধাও হওয়ার পরেই সিবিআই-কে লেখা সারদা-কর্তার দীর্ঘ চিঠিটিও সেই পরিকল্পনার অঙ্গ বলে সন্দেহ কুণালের। চিঠিটি সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের শীর্ষনেতা মুকুল রায় এই অভিযোগও করেছেন কুণাল। তাঁর ৯১ পাতায় লিখিত বয়ানে সেই সব কথা বলা আছে। আপাতত যা তদন্তকারীদের হাতে। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য জানতে বারবার ফোন করা হলেও মুকুল ফোন ধরেননি।
সুদীপ্তর অজ্ঞাতবাস ও অসঙ্গতি
সুদীপ্ত সেনের শেষদিকটা পুরো মিথ্যাচার, রহস্য, গোপনীয়তা অসঙ্গতিতে ভরা।
১। মিডিয়া ব্যবসা যে বড় লগ্নির/প্রথম ক’বছর ক্ষতির সারা পৃথিবী জানে। তবু তিনি মিডিয়াতে এলেন কেন? আর এলেনই যদি, এত সংখ্যায় করলেন কেন? বারণ করলেও কমাননি কেন? এর সঙ্গেই প্রশ্ন : যখন অর্থসঙ্কট, চালাতে পারছেন না, দু’তিন মাস আগে বললেন না কেন? কেন প্রকৃত অবস্থা গোপন রেখে শেষমুহূর্তে বন্ধের কথা বলে কর্মীদের বিপদে ফেললেন? কেন সময় থাকতে বিকল্প ব্যবস্থা করে মিডিয়াগুলিকে বেঁচে থাকার সুযোগ দিলেন না?
২। বিপদ দেখে যখন সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছি, সিএম-কে বলেছি, তখন মুকুল রায় নিজাম প্যালেসে বৈঠক ডাকল। (৫ এপ্রিল, ২০১৩??) সুদীপ্ত এলেন। গোটাটাই অস্বাভাবিক। রজত মজুমদারকে রেখেছিল মুকুল। আমি, সোমনাথদা (দত্ত, সারদার সিইও) ছিলাম। অত গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি। কোনও আলোচনা হল না। সুদীপ্ত বললেন, দেরি হয়ে গেল, আমি যাই। মুকুল বলল, ঠিক আছে। রজতদা বলল, আপনার অফিসে গিয়ে কথা বলে নেব।
আমার সন্দেহ হয়েছে। গট আপ কিছু চলছে না তো?
৩। রজত মজুমদার এরপর সেন-এর অফিসে যান। কিন্তু মুকুল আমাকে বিন্দুবিসর্গ জানায়নি। এটাও রহস্য।
৪। শুনেছি, সেন-রজত দীর্ঘ বৈঠক হয়। কিছু মিডিয়া হাতবদলের আনুষ্ঠানিক কাগজ হয়। রজত ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট (১৫০০০ টাকা) নিয়ে গেছিলেন ‘কলম’ কাগজের জন্য। আরও বিস্তারিত বহু কথা হয়। এই কথা নাকি ক’দিন ধরেই চলছিল। নিজাম প্যালেস বৈঠক আমাদের সামনে শুধু নাটক।
৫। ঘটনাচক্রে, এই সময়ই সিবিআই-কে লেখা সেন-এর চিঠি। আমি প্রথম থেকে বলে আসছি, চিঠিটা স্বাভাবিক না। কোনও ‘প্লি/প্লট আছে। হয় সেন নিজে লেখেনি। নইলে কেউ বসে লিখিয়েছে।
এতদিন পর সেন মিডিয়ার সামনে বলল, সিবিআই-কে লেখা চিঠি ওর নয়। এর মানে কী? নাটক হচ্ছে?
৬। সেন উধাও হল। পালিয়েছে? বিশ্বাস করি না। কলকাতা-র তিনটে মোবাইল অন রেখে কেউ পালায়? ওকে ক’দিন দূরে থাকতে বলা হয়েছিল।
মুকুলকে বললাম, পুলিশকে বল খুঁজে দিতে। কিছু ঘটছে। গুরুত্বই দিল না। বলল, নিশ্চিন্ত থাকো।
সোমনাথ দত্তর মাধ্যমে আইপিএস ভারতী ঘোষকে বললাম, খুঁজে দিন। ভারতী ঘোষ আন-অফিসিয়ালি করলেন। পরপর ক’দিন। সেনউত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, আরও উত্তরে।
মুকুলকে এটা বলা যাচ্ছে না। আলাদা চাপ দিচ্ছি। নিষ্ক্রিয়। আর ক’দিন পর রাতে নিজাম প্যালেসে তারা টিভি-র ক’জন আর আমিমুকুল তখন ফোনে আইপিএস রাজীব কুমারকে বলল সেন-এর মোবাইল ট্র্যাক করতে।
৭। সেন উধাও। ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, দিল্লি ১৮ সাউথ অ্যাভিনিউ। মুকুলের বাড়ি। কে ডি সিং (রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ), আসিফ-রা। জরুরি বৈঠক। সে দিন মুকুল আমাকে সেন-এর সিবিআইকে লেখা চিঠি দেখাল। বলল, সিবিআই থেকে এনে দিয়েছে প্রিয়াঙ্কা ইংটির বর। এটাও অস্বাভাবিক। সে দিন মুকুল নিজে চিঠিটা মিডিয়াকে দিল।
৮। আমার বিশ্বাস সুদীপ্তর এই প্লট মুকুলদের অনুমোদনে।
সুদীপ্ত চিঠি লিখে চলে যাবে। মিডিয়া ইউনিট এর বদনাম। আমার সর্বনাশ। আমার ক্ষতি। দলে কোণঠাসা।
মিডিয়া ইউনিটগুলো নিয়ে মুকুলরা চালাবে। যার জন্য বন্ধের আগে বিকল্প ব্যবস্থা করতে দেয়নি সেন। জানত, গট আপ খেলা। ক’দিন বন্ধ। তার পর কাগজ-কলমে হাতবদল চালু)।
সেন ফিরলে তখন তাঁর যেটুকু টাকা দরকার বলে প্রচার, মুকুলরা দিয়ে দেবে।
সুদীপ্ত ভেবেছিল, টিএমসি-র এতো উপকার করেছে, সব পরিকল্পনামত চলবে। মুকুল/রজতদের উপর নির্ভর করেছিল।
কিন্তু অর্পিতা ঘোষকে দিয়ে থানায় এফআইআর করিয়ে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিল টিএমসি। মানুষের কাছে ভালো সাজার খেলা।
সুদীপ্ত প্রথমে ওদের কথায় স্বেচ্ছায় চলেছে। পরে বাধ্য হয়ে। কিন্তু ঠিক কোন অংশে সেন প্রথম ধাক্কা খেল, জানার কৌতূহল আছে। আলিপুর কোর্ট, আলিপুর জেলে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেনি।
শুধু বলল, ‘ওরা আমাকে শেষ করে দিল’।
মমতা এবং পার্টি সারদার কিছু মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল প্রচারে। যে তৎপরতায় এখনও এগুলি চলছে, রাজ্যে কোনও চা বাগান বা কারখানা বন্ধ হলে, শাসকদল কর্মী স্বার্থে এই তৎপরতা দেখায় না।
আমাকেও ফেলা দরকার ছিল। সারদা প্লট-এ সেনকে কনফিডেন্সে নিয়ে আমাকে শেষ করার চেষ্টা হয়। মূর্খ, উপরচালাক সেন এদের বিশ্বাস করে এখন আফসোস করছে। কিন্তু ওর এখন ওদের মুঠো থেকে বেরনোর উপায় নেই।
সুদীপ্তর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ সবরকম সুবিধা নেওয়ার পর এখন মুছে ফেলার খেলা চলছে। যাদের ক্যাশ দিয়েছে সেন, প্রমাণ নেই বোধহয়, এখন বলতেও পারছে না। কিছু কিছু কথায় যা আন্দাজ করছি, সেন-এর বেশ কিছু টাকা কয়েক জনের কাছে আছে। সেন না পারছে তাদের বিরোধিতা করতে, না পারছে পরিস্থিতিটা গিলতে।
সেনকে বলা হয়েছিল সিবিআইকে এটা লিখে তুমি দূরে থাকো। আমরা দেখছি। এখন যেটুকু টাকা দরকার, দিয়ে দেওয়া হবে। মিডিয়া আমরা চালাব (এর আগে এবং পরের ঘটনাক্রম মুকুল, রজত, সুদীপ্ত সেন বলতে পারবে)।
বিপর্যয় যখন নিশ্চিত, সারদা মিডিয়া বন্ধের মুখে, সুদীপ্ত উধাও হওয়ার আগে বিকল্প পদ্ধতিতে মিডিয়া বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা হয়েছিল। সুদীপ্ত তাতে নিজে থেকে কথা এগোন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রহস্যজনক কারণে অসহযোগিতা করেন। চ্যানেল-টেন, তারা ২টি ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। বিকল্প অর্থ সূত্রের সঙ্গে প্রক্রিয়া এগিয়েও বন্ধ করেন আচমকা। এতে কর্মিস্বার্থ বিপন্ন হয়।
(বানান অপরিবর্তিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy