বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভাল কাজ না। এ রাজ্যে কথাটা যে এমন অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে উঠবে, ভাবতে পারেননি চাষিরা। খাজনা জমা দিতে এখন শ’য়ে শ’য়ে চাষি সকাল থেকে লাইন দিচ্ছেন। রাত ৮টা-৯টাতেও খাজনার রসিদ কেটে দিতে দিতে গলদঘর্ম হচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা। আজ, রবিবারও বহু ব্লকে কৃষিজমির খাজনা নেওয়া হবে।
নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, হুগলি, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, দুই মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ
২৪ পরগনা, মালদহের বেশ কিছু এলাকায় শনি-রবিবার খাজনা নেওয়ার জন্য অফিস খোলা থাকছে। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে গভীর রাত পর্যন্ত ব্লক অফিসে খাজনার কাজ হয়েছে। অনেক গ্রামে শিবির করে খাজনা নেওয়া হচ্ছে।
কেন এমন খাজনা মেটানোর ধুম?
কৃষি দফতর জানাচ্ছে, বন্যার ক্ষতিপূরণ পেতে গেলে যে আবেদন জমা দিতে হবে, তাতে জমির নথিপত্র, ব্যাঙ্কের পাশবইয়ের প্রতিলিপির সঙ্গে থাকতে হবে খাজনার রসিদও। প্রতি একরে বছরে ২০ টাকা হারে খাজনা দিতে হয় চাষিদের। জমির মাপ অনুসারে সরকার বন্যার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে ন্যূনতম এক হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৭ হাজার টাকা।
স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা চাইছেন খাজনা মিটিয়ে ক্ষতিপূরণ পেতে। কিন্তু জেলায় জেলায় দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ চাষিরই খাজনা দেওয়া বাকি। যেমন, নদিয়ার ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের এক ব্লক স্তরের আধিকারিক বলেন, প্রতি ব্লকে গড়ে ১৫ হাজার চাষি ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে বড় জোর দু’তিন হাজার চাষির খাজনা দেওয়া রয়েছে।
বন্যার্তরা যাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত না হন, সে বিষয়ে কড়া নির্দেশ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ভূমি রাজস্ব দফতরের এক শীর্ষকর্তা কবুল করলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ বলে কথা, তাই খাজনা সংগ্রহে এখন ছুটির দিন বা শনি-রবিবার বলে কিছু নেই। জেলার কর্মীরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে ছুটির দিনে অফিস খোলা রাখছেন।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক ব্লক আধিকারিকের কথায়, “আগে দিনে বড় জোর ১৫-২০ জন খাজনা দিতে আসতেন। গত কয়েক দিন ধরে দু’-তিনশো জন ভিড় জমাচ্ছেন। যত দিন যাবে সংখ্যাটা তো ততই বাড়বে।”
সেই সঙ্গে বাড়ছে গণ্ডগোলের আশঙ্কাও। নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় সম্প্রতি সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়েও খাজনা দিতে না পেরে ইট ছুড়তে থাকেন চাষিদের একাংশ। পুলিশকে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরে আবার আশঙ্কা, খাজনা কাটার রসিদ বই কম পড়তে পারে। দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “যে ভাবে খাজনা দেওয়ার লাইন পড়ছে তাতে বড় জোর সোম-মঙ্গলবার পর্যন্ত চলবে।’’ কিন্তু ডাইরেক্টরেট অব ল্যান্ড রেকর্ডস বলেছে, বুধবার নতুন বইয়ের জন্য খোঁজ নিতে। তাই বিক্ষোভের আশঙ্কা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন হল, খাজনা এত বাকি কেন?
খাজনা নিতে গিয়ে সরকারি কর্তারা দেখছেন, কারও ২৫ বছর, কারও ১৪-১৫ বছর খাজনা বাকি। যেখানে একর প্রতি (কমবেশি তিন বিঘে) খাজনা মাত্র ২০ টাকা, সেখানে কেন এ ভাবে খাজনা ফেলে রাখেন চাষিরা? নদিয়ার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, ‘‘খাজনা ফেলে রাখলে চাষির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করার তেমন কোনও সুযোগ নেই। তাই রায়তরা খাজনা ফেলে রাখেন।’’
চাষিরা দায়ী করছেন সরকারি ব্যবস্থাকেই। গ্রাম পঞ্চায়েত পিছু এক জন করে ‘ভূমি সহায়ক’ থাকার কথা, যাঁরা চাষিদের থেকে জমির খাজনা আদায় করবেন। বর্ধমানে ২৭৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের অর্ধেকেই ভূমি সহায়ক নেই। খণ্ডঘোষের চাষি শেখ রবিউল সকাল থেকে খাজনার লাইন দিয়ে বিরক্ত। বললেন,‘‘বছরে এক বার এ ভাবে খাজনা নেওয়ার তাগিদ দেখালে চাষিদের সমস্যায় পড়তে হয় না।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত আর্থিক বছরে অগস্ট মাস পর্যন্ত খাজনা আদায় হয়েছিল ২ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা। চলতি আর্থিক বছরে এই সময়ে খাজনা আদায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা। অর্থাত্ ইতিমধ্যেই জেলায় ২৬ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত খাজনা আদায় হয়ে গিয়েছে। প্রায় একই ছবি সব জেলাতে। রাজ্যে অনাদায়ী খাজনা কত ছিল, সেই হিসবেটাও এ বার মিলবে, মনে করছেন সরকারি কর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy