Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

কখন যেন ফস্কে গেল খুদে হাতটা

নৌকা ভেঙে জলে পড়ে ভেবেছিলাম, মরেই গিয়েছি। একটু ধাতস্থ হতে বুঝলাম, জলের মধ্যেই পা-টা আঁকড়ে ধরেছে কচি হাত। তাকে সেই অবস্থায় নিয়েই জল থেকে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মাথাটা তোলার আগের মুহূর্তে পা ছেড়ে দিল খুদে হাত দু’টো। নিজে বাঁচলাম। কিন্তু এই আফশোস বাকি জীবনে যাবে না।

শান্তিপুরের কালনাঘাটে জনরোষে জ্বলছে নৌকা। রবিবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

শান্তিপুরের কালনাঘাটে জনরোষে জ্বলছে নৌকা। রবিবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

গৌতম সেন (শাড়ি ব্যবসায়ী)
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০৩:৪৯
Share: Save:

নৌকা ভেঙে জলে পড়ে ভেবেছিলাম, মরেই গিয়েছি। একটু ধাতস্থ হতে বুঝলাম, জলের মধ্যেই পা-টা আঁকড়ে ধরেছে কচি হাত। তাকে সেই অবস্থায় নিয়েই জল থেকে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মাথাটা তোলার আগের মুহূর্তে পা ছেড়ে দিল খুদে হাত দু’টো। নিজে বাঁচলাম। কিন্তু এই আফশোস বাকি জীবনে যাবে না।

পূর্বস্থলীর তামাঘাটায় তাঁতিদের থেকে শাড়ি কিনে বিভিন্ন হাটে বিক্রির কাজ করছি অনেক বছর ধরে। প্রতি রবিবার শান্তিপুরের হাটে যাই। ওখানে আবার আমার শ্বশুরবাড়ি। শনিবার গিয়ে রাতটা শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে ভোর-ভোর পৌঁছে যাই হাটে। এ বার বিক্রি করার জন্য অনেক দিনের জমানো টাকায় ১৮টা জামদানি শাড়ি কিনেছিলাম। প্রত্যেকটার দাম নিয়েছিল ১৪০০ টাকা করে। কিন্তু ঘাটে পৌঁছতে একটু রাত হয়ে গেল। সেটাই বোধহয় কাল হল!

কাপড়ের গাঁটরি আর ব্যাগ হাতে ঘাটে পৌঁছে দেখি, থিকথিক করছে ভিড়। মনে পড়ল, ভবা পাগলার মন্দিরে উৎসব ছিল। সে জন্য নদিয়া থেকে মানুষজন এসেছিলেন। তাঁরা সবাই বাড়ি ফেরার জন্য দাঁড়িয়ে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ফেরি চলাচল বন্ধ। ভিড়ের মধ্যে কোনও রকমে জেটির সামনের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।

একটু পরে একটা নৌকা এল। ব্যস, প্রবল ধাক্কাধাক্কি শুরু। তার মধ্যেই নৌকায় উঠে গেলাম। ভাল করে দাঁড়াতেও পারছিলাম না। যত জন পেরেছে, উঠে পড়েছে। অনেকের সঙ্গে আবার সাইকেল। অবস্থা দেখে একটু ভয়ই হচ্ছিল। হঠাৎই মনে হল, এক সঙ্গে অনেকে হুড়মুড় করে ঝাঁপ দিল নৌকায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিঁড়ে গেল জেটিতে বাঁধা দড়িটা। এত লোকের ভার সামলাতে না পেরে টাল খেয়ে গেল নৌকাটা। প্রচণ্ড চিৎকারের মধ্যেই মড়মড় শব্দ করে সেটা ভেঙে ডুবতে শুরু করল।

তখন ডুবে যাচ্ছি। কোনও রকমে মাথা সোজা করতেই বুঝতে পারলাম, কেউ একটা আমার ডান পা জাপটে ধরেছে। ওজন বেশি না হওয়ায় বুঝলাম কোনও শিশু। ঠিক করলাম, ওকে সঙ্গে নিয়েই উঠব। সাঁতারটা ভালই জানি। তবে শনিবার রাতে তা এ ভাবে কাজে লেগে যাবে বুঝিনি। সাঁতারে উপরে উঠছি, আচমকা পা থেকে হাত দু’টো সরে গেল। ওকে বাঁচানোর আর কোনও উপায় ছিল না আমার।

জল থেকে মাথা তুলে দেখি, সামনেই আমার সাদা কাপড়ে মোড়া শাড়ির গাঁটরিটা ভাসছে। ভাবলাম, যাক, তবু পঁচিশ হাজার টাকাটা মার যায়নি। তখনই আলো-আঁধারিতে চোখে পড়ল গাঁটরির কাছে মাঝবয়সী এক মহিলা হাবুডুবু খাচ্ছেন, কিছু একটা ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করছেন। হাত দিয়ে শাড়ির গাঁটরিটা ঠেলে দিলাম তাঁর দিকে। সেটা আঁকড়ে ধরলেন তিনি। খুদেটাকে বাঁচাতে পারিনি আমি, কিন্তু আমার কষ্ট করে জমানো পুঁজি একটা প্রাণ বাঁচাল। খানিক শান্তি পেলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

boat accident Ferry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE