Advertisement
E-Paper

কার ‘কেক’ কে কাটে

কয়লাঞ্চলে বাবুলের প্রচার শুরুই হচ্ছে, ‘‘মুনমুন সেনের দেওয়াল লিখন এত বেশি কেন? ওদের কয়লার টাকা’’—এই নালিশে।

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৩৭
মুনমুন সেন ও বাবুল সুপ্রিয়।

মুনমুন সেন ও বাবুল সুপ্রিয়।

আসানসোল লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মুনমুন সেনের নাম ঘোষণা হতেই শুভার্থীরা টুইট করেছিলেন বাবুলের জন্য এটা ‘কেকওয়াক’। ভাবটা ছিল এমন, যেন বিজেপিকে ফাঁকা মাঠ ছেড়েছে রাজ্যের শাসক দল। এলাকা ঘুরে মনে হচ্ছে এখানে ‘কেক’ তৈরি হয় পাচারের কয়লা, কারখানা বন্ধ হওয়ার ক্ষোভ, ধর্ম ও ভাষা নিয়ে সংবেদনশীলতা এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব দিয়ে। তা বানানো এবং হজম করা শক্ত।

কয়লাঞ্চলে বাবুলের প্রচার শুরুই হচ্ছে, ‘‘মুনমুন সেনের দেওয়াল লিখন এত বেশি কেন? ওদের কয়লার টাকা’’—এই নালিশে। ফুঁয়ে তা উড়িয়ে জেলায় তৃণমূলের পর্যবেক্ষক তথা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য, কয়লা চুরি দেখার কথা কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফের। কেন্দ্রের ‘মদত’ না থাকলে কয়লা চুরি সম্ভব নয়। বলছেন, ‘‘দেওয়াল লেখার লোক নেই। পাশে কেউ নেই। হারের ভয়ে বলতেই হয় এ সব।’’

বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রচার-গাড়ি ঢুকছে বারাবনি বিধানসভার গ্রাম-গলিতে। দরজা ঠেলে বেরোন প্রৌঢ়। বিদায়ী সাংসদের প্রতি উড়ে যায় তাঁর মন্তব্য, ‘‘হিন্দুস্তান কেব‌্লসে চাকরি করতাম।’’ বাবুল বলেন, ‘‘ভিআরএস (ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিম)-এর টাকা পেয়েছেন তো?’’ প্রৌঢ় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখান। প্রচার-গাড়ির ডালার পিছনে দৌড়ে চলা এক তরুণ পাশের দৌড়বাজকে বলেন, ‘‘দাদাকে থাম্বস আপ দেখাল।’’ যাঁকে বলা হল, তিনি বুঝিয়ে দেন, ‘‘আসলে ওটা কাঁচকলা।’’ বাবুল পরে বলেন, ‘‘অনেকেই ওই টাকা পেয়েছেন।’’

বিজেপি প্রার্থীর বক্তব্য, তিনি সাংসদ হওয়ার আগেই ঋণের চাপে, শ্রমিক-সমস্যায় হিন্দুস্তান কেব‌্লস, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড-এর মতো প্রতিষ্ঠান ‘নড়বড়ে’ হয়ে পড়েছিল। পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, সংস্থাগুলিকে ‘মৃতপ্রায়’ করায় দায় বাম এবং তৃণমূল কেন নেবে না। ‘‘এক বার আসুন উনি এ দিকে। বুঝিয়ে দেব’’—যাঁরা বলছেন, তাঁরা বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের ঠিকা-শ্রমিক, বার্নপুরের বাসিন্দা। উছলে আসে ক্ষোভ, ‘‘কারখানাটা যদি মরতে চলা রোগীই হবে, খোলানোর আশা দিয়েছিলেন কেন?’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে পানীয় জলের বন্দোবস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা না-রাখার অভিযোগও রয়েছে নানা প্রান্তে। বারাবনির সংগ্রামগড়ে বিদায়ী সাংসদ বোঝাচ্ছেন, ‘‘যত ক্ষণ পঞ্চায়েত স্তরে তৃণমূল থাকবে, তত দিন আমার কাজের সুফল পাবেন না।’’ গাইছেন গান, ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’। ভিড় চুপ। প্রার্থীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘ফ্রি-তে গাইলাম বলে হাততালি দিলেন না দিদিরা!’’

২০১৪-য় যিনি আসানসোলে ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ করেছিলেন, সেই বাবুল বলে চলেন, ‘‘সামান্য একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মানসিকতা হয়তো রয়েছে। তবে গ্রামের অলিগলিতে যে ভাবে আমার গাড়ি নিয়ে যেতে বলছেন মানুষ, তাতে বুঝতে পারছি ওঁরা ভালবাসেন। জিতব অন্তত দু’লক্ষ ভোটে।’’

বিজেপির অন্দরে অবশ্য বাবুল ‘সুপ্রিয়’ নন, তিনি পুরনো নেতাদের সম্মান ‘না দেওয়ায়’ দলেরই একাংশের উদ্যোগে শিবসেনার প্রতীকে দাঁড়িয়েছেন ‘হিন্দু মহাসভা’র এক জন, একাধিক প্রবীণ নেতা দলের কাজ নিয়ে জেলার বাইরে চলে গিয়েছেন শোনা যাচ্ছে এমনও। তবে বিজেপি প্রার্থীর বক্তব্য, ‘‘স্বার্থান্বেষীদের অপপ্রচার।’’

তা হলে কি বাবুলের কেকের উপাদান কম পড়ছে? মোটেও না। নেতারা না মানলেও তৃণমূলের একাংশের বিরুদ্ধে তোলাবাজি, গা-জোয়ারি, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে গোষ্ঠী-কোন্দল। যেখানে এক সময় ওপার বাংলা থেকে আসা জনতার বসতি, সেখানে অনেকের ‘উষ্মা’ রয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘু তোষণে’র অভিযোগে। আর রয়েছেন ‘মোদী’ (নরেন্দ্র)। ‘‘ওঁকে ছাড়া, কেন্দ্রে কাউকে ভাবা যাচ্ছে না’’—বরাকরের এক ব্যবসায়ীর করা এই দাবি পদ্ম-গন্ধের যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তার রেশ রয়েছে লোকসভার অবাঙালি মহলে। আসানসোলের প্রায় ১৬ লক্ষ ভোটারের অন্তত অর্ধেক অবাঙালি। সেই অর্ধেকের প্রায় ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘু।

তৃণমূলের পক্ষে পরিস্থিতি সহজ ছিল না। প্রার্থী ঘোষণার আগে হাওয়া উঠেছিল এলাকার এক হিন্দিভাষী নেতা এ বার ‘টিকিট’ পাচ্ছেন। জনশ্রুতি, দলে অন্যদের আপত্তিতে তাতে কাঁচি পড়ে। চটে যাওয়া হিন্দিভাষী কর্মীরা বলতে শুরু করেন, ‘‘ভাইয়া কা কেয়া হুয়া?’’ আসরে প্রবেশ আসানসোলে তৃণমূলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারির। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিহারি (হিন্দিভাষী) মাত্রই না কি বিজেপি সমর্থক, এমন একটা বদনাম রয়েছে। এ বার তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বদনামটা ঘোচাতে হবে।’’

দলের অন্দরের খবর, ২০১৪ সালে দোলা সেনকে জেতাতে না পারায় যদি দলের কাউকে কাঠগড়ায় তোলা হয়ে থাকে, এ বারও তেমন হতে পারে। এলাকার বাসিন্দা রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক বলেছেন, ‘‘এ বার দলের জন্য সবাই এক।’’ তবে অন্তত দু’জন তৃণমূল বিধায়ক ঘনিষ্ঠ মহলে মানছেন, ‘‘সবাই এক সঙ্গে হলে এখনই বলতাম জিতে গিয়েছি।’’

ওয়াকিবহাল তৃণমূল প্রার্থী। বলছেন, ‘‘আমি তৃণমূল করি। দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা করি, ওঁর জন্য করি।’’ ভোটের মরসুমে বা পরে বিশেষ কারও উপরে নির্ভরতা দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব খুঁচিয়ে দেয়। তেমন সম্ভাবনা খারিজ করে মুনমুন বলছেন, ‘‘যদি কাজ করার সুযোগ পাই, জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে করব।’’ তৃণমূল প্রার্থীর দাবি, যাত্রায় অভিনয় করার সুবাদে গ্রামের মানুষকে কাছ থেকে দেখায়, তাঁদের অভিব্যক্তি বোঝায় তিনি অভ্যস্ত। তাই প্রত্যয়, ‘‘ওরা কোনও (বিজেপি) কথা রাখেনি। আমি জনতার আশীর্বাদ পাব।’’

জনতার ‘আশীর্বাদ’ ছাড়াও তৃণমূলের অনেকের নজর রয়েছে সিপিআইএম প্রার্থী গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়ের ভোট-ব্যাঙ্কে। তাঁদের ধারণা, অত্যন্ত স্বচ্ছ ভাবমূর্তির গৌরাঙ্গবাবু একাধিক বিধানসভায় বামেদের নিজস্ব ভোট ধরে রাখবেন। রাতে অবসর পেলে টেলিস্কোপে চোখ রেখে আকাশ দেখতে পছন্দ করা গৌরাঙ্গবাবু অবশ্য গোটা লোকসভা আসনেই লাল ঝান্ডার বিস্তার দেখছেন। যুক্তি, ‘‘মোদী-হাওয়া নেই। তৃণমূলের অপশাসনে মানুষ ক্ষিপ্ত।’’ এক ধাপ এগিয়ে তাঁর দাবি, কংগ্রেসের একাংশ তাঁকে ভোট দেবেন। এ দাবি অলীক-কল্পনা ঠেকছে না। কংগ্রেস প্রার্থী বিশ্বরূপ মণ্ডল ‘বহিরাগত’ বলে ক্ষোভ রয়েছে দলের অন্দরে। তবে বামফ্রন্টের একটি সূত্র জানাচ্ছে, যে সব এলাকায় বামেদের সংগঠন ততটা ‘পোক্ত’ নয়, সেখানে তৃণমূল-বিরোধী ভোট কোন শিবিরে যাবে তা নিয়ে জল্পনা জমজমাট।

এমন সব ‘রেসিপি’ যেখানে, সেখানে বাবুলের কেকের ‘আইসিং’ (সজ্জা) হতে পারে আসানসোল দক্ষিণের সেই যুবকের ভাবনা। বাবা কাজ হারিয়েছেন বার্ন স্ট্যান্ডার্ডে। পাঁচ বছরে সাংসদকে শুধু ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় দেখা এই বছর তেইশ বলছেন, ‘‘আসল লোক হলেন মোদী। উনি বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক করতে পারেন। বন্ধ কারখানাও খুলতে পারেন।’’ মুনমুনের কেকের জন্য থাকবেন রানিগঞ্জের গ্রামের সেই বধূ, যিনি ঘাসফুলের ব্যানারে
সুচিত্রা সেন আর সামনে তাঁর ভোট চাইতে আসা মেয়েকে দেখে আপ্লুত। তাঁর কথায়, ‘‘মায়ের সঙ্গে খুব মিল মেয়ের। আমার প্রিয় বই (ছবি) সপ্তপদী।’’

Lok Sabha Election 2019 Moon Moon Sen Babul Supriyo BJP TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy