Advertisement
E-Paper

পুষ্করিণী-পৃথিবীতে ভরসা শামুক

বস্তায় রয়েছে জলকেঁচো, শামুক, গুগলি, ছোট ছোট গোসাপ ইত্যাদি। বালিচকের মিতা মল্লিক বলছিলেন, বাসি ভাত, মুড়ি, ঘুগনি ইত্যাদি খেয়ে তাঁরা দল বেঁধে ভোরের ট্রেন ধরেন।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০৫:২৮
তাঁদের গ্রামের বাড়িতে মিতা ও সীমা। নিজস্ব চিত্র

তাঁদের গ্রামের বাড়িতে মিতা ও সীমা। নিজস্ব চিত্র

হাওড়া জেলার জলাভূমি এই গরমে জঙ্গলমহলকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

বৈশাখের বিকেলে খড়গপুরগামী লোকাল ট্রেন। কামরায় কয়েক জন মেয়ে, সঙ্গে বড় বড় প্লাস্টিকের বস্তা। কিছু নেমে গেল হাউর, রাধামোহনপুর স্টেশনে। কিছু বস্তা আবার নামল খড়গপুর স্টেশনে, মেয়েরা সেগুলি মাথায় নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন ৪এ প্ল্যাটফর্মের দিকে।
ঝাড়গ্রাম, গিধনিগামী লোকাল সেখান থেকেই ছাড়ে।

বস্তায় রয়েছে জলকেঁচো, শামুক, গুগলি, ছোট ছোট গোসাপ ইত্যাদি। বালিচকের মিতা মল্লিক বলছিলেন, বাসি ভাত, মুড়ি, ঘুগনি ইত্যাদি খেয়ে তাঁরা দল বেঁধে ভোরের ট্রেন ধরেন। তার পরে কেউ নামেন বাগনান, কেউ ফুলেশ্বর, আবাদা, কেউ বা মৌড়ীগ্রাম স্টেশনে। নেমে কখনও কাছাকাছি গ্রামে, কখনও বা বাসে করে আরও ভিতরে অন্য কোনও গ্রামে। অতঃপর সেখানকার জলায় গেঁড়ি, গুগলি, কটু (ছোট কচ্ছপ) খোঁজা।

কোন স্টেশনে দল নামবে, ঠিক নেই। দু’ দিন বাগনান হলে তার পরের তিন দিন হয়তো মৌড়ীগ্রাম ।

গ্রামের পুকুরে গেঁড়ি, গুগলি খোঁজার জন্য আগে পয়সা দিতে হত না। সীমা মল্লিক বলছিলেন, এখন কোনও কোনও ঝিল মাস পাঁচেকের জন্য হাজার চারেক টাকা জমা নেয়। দলের দশ-পনেরো জন চাঁদা তুলে সেই টাকা জোগাড় করেন। অতঃপর সবাই মিলে দুপুর অবধি তন্নতন্ন করে জলার আগাছা হাতড়ানো। কোনও কোনও পুকুরমালিক আবার উদার। তাঁরা বলে দেন, গেঁড়ি-গুগলি খোঁজার আগে পুকুরের ধারের আগাছা, জঙ্গল সাফ করে দিতে হবে। বিনিময়ে দুপুরে তিনি ভরপেট ভাত দেবেন। পয়সা এবং গতর-খাটানো বিনিময় প্রথা দুটোই এই পুষ্করিণী-পৃথিবীতে স্বাগত।

দলটা ফেরার পথে আবার লোকাল ট্রেনে ওঠে। পাঁশকুড়া, হাউরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বস্তা কিনে নেয়। ছোট গুগলি সব চেয়ে দামি, ৮ টাকা কেজি। আর বড় শামুক, ঝিনুক হলে কেজিতে পাঁচ টাকা। নগদ পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরে রান্না। পর দিন সকালে ফের সেই রুটিন।

মিতারা জাতিতে শবর। মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে সাঁওতাল, মুন্ডা, শবর প্রায় এক। কিন্তু ফারাক আছে। সাঁওতাল, মুন্ডারা বহু কাল চাষবাস করেন, নিকোনো ঘরদোর ছবির মতো সুন্দর। ‘দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিমডিম রবে/ সাঁওতাল পল্লিতে উৎসব হবে,’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার ওই সময়েই, ১৯৩১ সালেই ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার শবরদের ‘ডাকাত ও অপরাধী জাতি’ বলে দেগে দিচ্ছে। অরণ্যচারী এই জনজাতি তখনও কৃষির সংস্পর্শে আসেননি, শিকারই জীবিকা। উপনিবেশের বাবুরা তাঁদের বাঁকা চোখে দেখবে, বলা বাহুল্য।

মিতা ও তাঁর দল আজ ভাগ্যক্রমে জলায় দুটি গোসাপ পেয়েছে। একটি রান্না করে খাওয়া হবে, অন্যটি কেটেকুটে, ছাল ছাড়িয়ে শবরপাড়ায় পরিচিত আগ্রহীদের কাছে বিক্রি করে দেবেন। ৬০ টাকা কেজি মাংস। ‘‘আগে আরও অনেক কিছু পাওয়া যেত। এখন এত কেমিক্যাল সার, পোকা মারার ওষুধের পাল্লায় কিছুই থাকে না। মানিকপাড়া, ঝাড়গ্রামে জলা শুকিয়ে যায়, হাওড়ার খালে তবু জিনিসপত্র মেলে,’’ বললেন মিতার ননদ সীমা। রাসায়নিকের দাপটে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শুনি, মিতাদের দেখে সেটি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

মিতা, সীমারা দু’টাকা কেজি চাল পান। মাঝে মাঝে জঙ্গলে খাম আলু পাওয়া যায়। কিছু সব্জি কিনতে হয়। পাতে মহার্ঘ ডাল এবং মাছ রোজ জোটে না। প্রোটিন বলতে এই গেঁড়ি-গুগলি-গোসাপই ভরসা। গোসাপ শুনে শিউরে ওঠার কিছু নেই। ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর কালকেতু ব্যাধ গোসাপ শিকার করেই ঘরে ফিরেছিল।

বালিচকে নেমে টোটোয় চকসাহাপুর গ্রামের শবরপাড়ায় মিতাদের বাড়ি। বছরে বড়জোর ৪০ দিন খেতমজুরের কাজ জোটে। বোরো চাষের জন্য মালিকের থেকে দশ কাঠা জমি নিয়েছেন ভাগে। জানুয়ারি নাগাদ ধান বুনে মে মাসে, সাড়ে তিন মাসের মধ্যে ঘরে উঠিয়ে ফেলা যায় এই ধান। ২৫ শতক জমিতে গড়পরতা ১২ মণ ফসল, তার তিন মণই মালিককে দিয়ে দিতে হবে। বিদ্যুৎচালিত মিনিপাম্পের খরচ বাবদ দেড় হাজার টাকা। কীটনাশক, সারের খরচ চাষির। অরণ্যসভ্যতা থেকে কৃষিসভ্যতায় উল্লম্ফন কি চাট্টিখানি কথা!

মিতার ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক ফেল করে এখন বাড়ি ঢালাইয়ে মজুরের কাজ করে। গ্রামে চকসাহাপুর লোধা সেবক সংঘের মেয়ে হোস্টেল আছে। মেয়েরা সেখানে ক্লাস ফোর অবধি পড়াশোনা করে। ‘‘অন্তত, মাধ্যমিক অবধি মেয়েদের হোস্টেলটি জরুরি। বাবা, মা দু’জনে শিকারের খোঁজে, দিনমজুরির কাজে। মেয়েই তখন ঘর সামলায়, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করে। ক্লাস ফোরের পর বাড়ি ফিরে তাই পড়াশোনা আর সে চালাতে পারে না,’’ বলছিলেন লোধা সমাজসেবক সংঘের প্রহ্লাদকুমার ভক্তা। লোধা সমাজের প্রথম মহিলা স্নাতক, আত্মহত্যা করে যিনি জীবন শেষ করে দিয়েছেন সেই চুনি কোটালের মামা এবং লোধাশবর সমাজে প্রথম স্নাতক এই প্রহ্লাদবাবু। তাঁর সাফ কথা, লোধা বালিকার জন্য সাইকেলের থেকেও হোস্টেল জরুরি। মিতার ননদ সীমার স্বামী জাতিতে মুণ্ডা। সমাজে মেনে নিয়েছিল? সীমা হাসলেন, ‘‘মানবে না কেনে? এখানে আমরা সবাই এক বরামদেবতার (গ্রামদেবতা) পুজো করি। সাঁওতাল, শবর, ভুমিজ সবাই যাকে ইচ্ছা, শাল ফুল দিয়ে মিতান পাতাই। একই গ্রামে মানুষে মানুষে এত বিধিনিষেধ থাকে নাকি গো?’’

এখানেই অরণ্যচারী শবরসংস্কৃতি। বরামদেবতার পূজারীরা দেখলাম, দেশদেবতার পূজারীদের থেকে অনেক উদার। মতান্তর হলেই লোককে পাশের গ্রাম পাকিস্তানে চলে যা বলে হুমকি দেয় না!

Sabar Sabar Tribe
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy