Advertisement
১৪ মে ২০২৪
Majida Khatun

জিমন্যাস্টিক্সে ‘প্রথমা’, তবু অর্থাভাবে আটকে বিদেশে লড়াইয়ের পথ

খড়্গপুরের বাসিন্দা মাজিদার জিমন্যাস্টিক্সে হাতেখড়ি ৮-৯ বছর বয়সে। পেশায় দর্জি, মাজিদার বাবা শেখ মাজিদ কাজ হারিয়েছিলেন লকডাউনের সময়ে। তখন থেকে চা বিক্রি করেই কোনও রকমে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার চালান।

স্বর্ণপদক জেতার পরে মাজিদা খাতুন।

স্বর্ণপদক জেতার পরে মাজিদা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত।

স্বাতী মল্লিক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:০২
Share: Save:

‘সোনার মেয়ে’!

গত ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল অ্যারোবিক জিমন্যাস্টিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে তিনটি বিভাগে সোনা জেতার পরে মাজিদা খাতুনকে এই নামেও এখন ডাকছেন অনেকে। স্বপ্ন দেখছেন, জিমন্যাস্টিক্সে এই সপ্তদশীই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। জম্মুতে ত্রিস্বর্ণপদক জয়ের রেকর্ডের পরেই মাজিদার কাছে এসেছিল জাপান ও ভিয়েতনামের প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে অংশ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু অর্থাভাবে সেই সুযোগ এখন প্রায় হাতছাড়া হতে বসেছে। এখনই টাকার জোগাড় না হলে, নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা মাজিদার সামনে বন্ধ হয়ে যাবে মে-জুনের ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার দরজা।

খড়্গপুরের বাসিন্দা মাজিদার জিমন্যাস্টিক্সে হাতেখড়ি ৮-৯ বছর বয়সে। পেশায় দর্জি, মাজিদার বাবা শেখ মাজিদ কাজ হারিয়েছিলেন লকডাউনের সময়ে। তখন থেকে চা বিক্রি করেই কোনও রকমে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার চালান। ফুটবল পাগল মাজিদ চেয়েছিলেন, বড় মেয়ে কোনও খেলাধুলোয় যাক। তাই প্রথমে এলাকার জিমন্যাস্টিক্স প্রশিক্ষকের কাছে ভর্তি করেন তাকে। মাজিদার কথায়, ‘‘দু’-তিন বছরের মধ্যেই অনেক উন্নতি করি। তার পরেই আসি বর্তমান প্রশিক্ষকের কাছে।’’

আপাতত নৈহাটিতে প্রশিক্ষক সম্রাট পালের বাড়িতে থেকেই চলছে দিনরাতের অনুশীলন পর্ব। তাঁর কাছে মাজিদা গর্বের বিষয়। এতটাই যে, ছাত্রীর জন্য জাতীয় স্তরে চ্যালেঞ্জ জানাতেও দ্বিধা করেন না। সম্রাটের কথায়, ‘‘ও আমার কাছে আসার তৃতীয় দিনেই বলেছিলাম, এই মেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরের খেলোয়াড় হবে। জিমন্যাস্টিক্সের প্রতি ওর আলাদা ঝোঁক রয়েছে। কিন্তু এ দেশে ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনও খেলায়
সরকারি সুবিধা তেমন মেলে না। রাজ্যের অবস্থাও তথৈবচ। ক্রিকেটে কী নেই! অথচ বাকি খেলাগুলোর কী দুরবস্থা!’’

প্রতিভা থাকলেও পকেটের জোর নেই মাজিদার। অসুস্থ বাবার থেকে নিজের খরচ চাইতে চায় না সে। মে মাসে জাপানের সুজ়ুকি ওয়ার্ল্ড কাপ এবং জুনে ভিয়েতনামের এশিয়ান অ্যারোবিক জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় এ রাজ্য থেকে সুযোগ পেয়েছে একমাত্র মাজিদাই। তবে তাতে যোগ দিতে টাকা তো লাগবেই! জাপানের খরচটা তারা দিলেও ভিয়েতনামে যাতায়াত-থাকা-খাওয়ার খরচ (প্রায় দেড় লক্ষ) দিতে হবে মািজদাকেই। সেখানে প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগও রয়েছে। ভবিষ্যতে ইটালির প্রতিযোগিতা নিয়েও স্বপ্ন বুনছে সে। তবে সব পথেই প্রধান অন্তরায় টাকা। মাজিদার শুভানুধ্যায়ীরা তাই ক্ষুব্ধ স্বরে বলছেন, ‘‘এ রাজ্যে ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলাকে যদি গুরুত্বই না দেওয়া হয়, তাহলে খেলে লাভ কী?’’ যদিও ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলছেন, ‘‘সরকার নিশ্চয়ই সহযোগিতায় পাশে থাকবে। নির্দিষ্ট করে আবেদন এলে নিয়মকানুনের মধ্যে ক্রীড়া দফতর তা বিবেচনা করবে।’’

মাজিদার সামনে অন্তরায় অবশ্য আরও আছে। মেয়েকে জিমন্যাস্টিক্স করতে দেওয়ার জন্য পরিজন-প্রতিবেশীদের থেকে কম কথা শোনেনি তার পরিবার। বাবা অবশ্য তাতে আমল দেননি। বরং আগলে রেখেছেন মেয়েকে। মাজিদার কথায়, ‘‘জিমন্যাস্টিক্সে ছোট পোশাক পরতে হয় বলে পরিজনেরা কথা শোনান আজও। ছোটবেলায় এক দাদা টোপ দিয়েছিল, জিমন্যাস্টিক্স ছেড়ে দিলে নাকি আমায় সাইকেল কিনে দেবে!’’ পাশে রয়েছেন মা রিনা বিবিও। মেয়ের জন্য নিজের সংসার ছেড়ে নৈহাটিতে পড়ে আছেন। বলেন, ‘‘মেয়ের জন্য তো এটুকু করতে হবেই। সব সময়ে ওর পাশে আছি।’’

অনুশীলনে অবশ্য খামতি নেই দ্বাদশ শ্রেণির এই ছাত্রীর। বলছে, ‘‘এর আগে তাইল্যান্ডের প্রতিযোগিতায় যাওয়ার টাকা তুলে দিয়েছিলেন আমার স্কুলশিক্ষকেরা। মঙ্গোলিয়া টুরের আগে পশ্চিম
মেদিনীপুরের জেলাশাসক ও এসপি সাহায্য করেন। গত বছর ন্যাশনাল গেমসে দ্বিতীয় হলে মুখ্যমন্ত্রী ২ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার অসুস্থতা, লাইসেন্স বানানো, জিমন্যাস্টিক্সের পোশাক কেনা— সব মিলিয়ে তার বেশির ভাগ খরচ হয়ে গিয়েছে।’’

তবু জিমন্যাস্টিক্সের ভল্ট-সমারসল্টে ভর দিয়েই জীবনের লড়াইটা জিততে চায় এই কন্যা। ভিতর থেকে কেউ যেন তাই সর্বদা বলে চলে— ‘ফাইট মাজিদা, ফাইট!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gymnastics financial crisis Gold Medalist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE