Advertisement
E-Paper

সংসদে টোস্ট, বাড়িতে চাইনিজ, মুকুলকে আপ্যায়ন মমতার

দুপুরে সংসদের সেন্ট্রাল হলে দেখা হতে কুশল জিজ্ঞাসা করে টোস্ট খেতে অনুরোধ। রাতে একেবারে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুকুল রায়ের সম্পর্কের বরফ গলল শীতের রাজধানীতেই।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:৩৬
আবার কি ফিরবে এই ছবি? ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪: গাঁধীমূর্তির পাদদেশে

আবার কি ফিরবে এই ছবি? ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪: গাঁধীমূর্তির পাদদেশে

দুপুরে সংসদের সেন্ট্রাল হলে দেখা হতে কুশল জিজ্ঞাসা করে টোস্ট খেতে অনুরোধ। রাতে একেবারে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুকুল রায়ের সম্পর্কের বরফ গলল শীতের রাজধানীতেই।

সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআইয়ের ডাক পাওয়ার পরে গত ১১ মাস ধরে মুকুলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না মমতার। সিবিআই সূত্রের দাবি ছিল, সারদার কাছ থেকে কী ভাবে সুবিধা নিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী, তার খতিয়ান দিয়েছেন মুকুল। তার পরেই দলের অঘোষিত দু’নম্বরকে ধীরে ধীরে ছেঁটে ফেলেন তৃণমূল নেত্রী। দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক পদ থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়িত্ব কেড়ে নিছক সাধারণ সাংসদ করে রাখেন মুকুলকে।

জল্পনা শুরু হয়, মুকুল দল ছাড়ছেন। গোড়ায় শোনা গিয়েছিল, বিজেপিতে যাচ্ছেন তিনি। তার পর কংগ্রেস। একেবারে শেষে আলাদা দল গড়ার কথাও ওঠে। ঝেড়ে না-কাশলেও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে সেই সব জল্পনায় ইন্ধন জোগান মুকুলও। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে আবার শোনা যাচ্ছিল, দূরত্ব কমছে মমতা-মুকুলের। দিল্লির দরবারে দেখা গেল সেটাই সত্যি।

আজ দুপুরে নিজের সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাসভবন থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণ মেনন মার্গের দিকে যাচ্ছিলেন মুকুল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিতে। মাঝ রাস্তায় মোবাইলে তাঁর কাছে খবর আসে, অরবিন্দ কেজরীবালকে নিয়ে সংসদের সেন্ট্রাল হলে পৌঁছেছেন মমতা। গাড়ি ঘুরিয়ে মুকুল চলে যান সংসদে। রাজ্যসভা মুলতুবি থাকায় হাজিরা খাতায় সই করে সটান পৌঁছে যান সেন্ট্রাল হলে।

কেজরীবালকে পাশে নিয়ে দলীয় সাংসদ পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন মমতা। ঝড়ের গতিতে সেন্ট্রাল হলে ঢুকে মুকুল চলে আসেন মমতার একেবারে সামনে। তাঁকে দেখেই মমতা বলেন, ‘‘মুকুল কেমন আছ?’’ মুকুল জবাব দেন, ‘‘ভাল আছি।’’ কুশল বিনিময়ের পরে মুকুলের সঙ্গে কেজরীবালের পরিচয় করিয়ে দেন মমতা। তার পর সামনে প্লেটে রাখা টোস্ট খেতে বলেন মুকুলকে। টোস্ট হাতে নিয়ে সেন্ট্রাল হল থেকে বেরিয়ে যান মুকুল।

মিলন-পর্বে দাঁড়ি পড়েনি এখানেই! ইদানীং দিল্লি এলে ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন মমতা। সেখানে আজ তৃণমূল সাংসদদের নৈশাহারের আসর বসেছিল। মমতা বলেন, ‘‘দুপুরে মুকুলকে ভাল করে খাওয়ানো হল না। ওকে কিছু খাবার পাঠালে হয়।’’ তার পরেই বলেন, ‘‘খাবার পাঠানোর কী দরকার! ও তো দু’টো বাড়ি পরেই থাকে। ডেকে পাঠালেই তো হয়!’’

ফোন যায় মুকুলের কাছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যান স্যুট-বুট পরিহিত মুকুল। তৃণমূল সাংসদদের আপ্যায়নে আজ আয়োজন ছিল চাইনিজ খাবারের। মুকুল জানান, ইদানীং তিনি পুজো-আচ্চা করেন, নিরামিষ খান। সৌমিত্র মোহন খানের জন্য সেই ব্যবস্থাও ছিল। তার থেকেই ভাগ পান মুকুল। তার পরে চলে দীর্ঘ আড্ডা। প্রায় দেড় ঘণ্টার আলোচনায় উঠে আসে রাজনৈতিক প্রসঙ্গও।

রাজ্যসভায় দলনেতার পদ হারিয়ে একেবারে পিছনের সারিতে চলে যাওয়া মুকুল দিন দশেক আগেই সেন্ট্রাল হলে স্যুপ খেয়েছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী, ডেরেক ও’ব্রায়েনের সঙ্গে। প্রশ্ন ওঠায় ডেরেক টুইট করেছিলেন, ‘‘স্যুপ খেয়েছি, বেশ হয়েছে!’’ তখনই মুকুলকে কাছে টানার ব্যাপারে তৃণমূল নেত্রীর আগ্রহের আভাস পেয়েছিলেন অনেকে। বুধবারের নৈশাহার সেই ধারণাকে পোক্ত করল।

প্রশ্ন হল, মুকুলের সঙ্গে দূরত্ব কেন ঘোচালেন মমতা? মুকুলই বা ফিরলেন কেন? দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে এই সাক্ষাৎকে অবশ্য আজ দু’জনেই খুব বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মানতে চাননি। মুকুল দুপুরেই বলেন, ‘‘প্রায় এগারো মাস পরে মমতাদির সঙ্গে দেখা হল। তবে এটি নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎ।’’ আর মমতার মন্তব্য ছিল, ‘‘সব দলীয় সাংসদের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে। মুকুলের সঙ্গেও হয়েছে। ও তো আমাদের সাংসদই।’’

কিন্তু একদা তাঁর সব চেয়ে আস্থাভাজন এই সাংসদকেই দলে প্রায় গত এক বছর কার্যত একঘরে করে ছেড়েছিলেন মমতা। মুকুলের সঙ্গে পারতপক্ষে বাক্যালাপ করতেন না তৃণমূল সাংসদরা। সেটা দলনেত্রীর রোষে পড়ার ভয়েই— এমনই গুঞ্জন ছিল তৃণমূলের অন্দরে। তবে মুকুলের অনুপস্থিতিতে সংগঠনের বাঁধন যে কিছুটা হলেও আলগা হচ্ছে, সেটাও কবুল করছিলেন তৃণমূল নেতাদের একাংশ। এটা ঠিক যে, মুকুলকে ছাড়াই লোকসভা, বিধানসভার উপনির্বাচন এবং পুরভোটে রমরম করে জিতেছে তৃণমূল। কিন্তু এটাও ঠিক যে, প্রায় সব ভোটেই বেআব্রু হয়ে পড়েছে দলের গা-জোয়ারি। স্পষ্ট হয়েছে, নিচুতলার উপরে নেতাদের নিয়ন্ত্রণহীনতা। মুকুলের আমলে যে ঘটনা ঘটেনি বলেই অনেক তৃণমূল নেতার অভিমত। তাঁদের মতে, গোটা রাজ্যে তৃণমূলের সংগঠনটা মুকুল হাতের তালুর মতো চেনেন। নেতা-কর্মীদের উপরে তাঁর নিয়ন্ত্রণও প্রশ্নাতীত। মুকুলের বিকল্প হিসেবে সংগঠনের দায়িত্ব যাঁদের দিয়েছিলেন, তাঁদের উপরে ভরসা করে আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে যাওয়া নিয়ে সংশয়ী মমতা— বলছেন অনেক তৃণমূল নেতাই।

তৃণমূলের বিকল্প খুঁজে পাননি মুকুলও। মমতার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরে প্রথম কয়েক মাস তিনি বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরির চেষ্টা করে গিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ তাঁর সঙ্গে একাধিক বার দেখা করলেও, তার বেশি জল গড়ায়নি। কারণ, সারদা-কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠায় মুকুলকে দলে নিতে আপত্তি ছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্বের একটা বড় অংশের। তখন কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মুকুল। কথা হয় সনিয়া গাঁধী, রাহুলের সঙ্গে। কিন্তু এখানেও ওঠে সেই এক প্রসঙ্গ— সারদা কেলেঙ্কারি।

এর পরে জল্পনা শুরু হয় মুকুলের নিজের দল নিয়ে। নতুন দলের নথিভুক্তি এবং প্রতীক চিহ্নের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন যাঁরা করেছেন, তাঁদের দাবি ছিল মুকুল তাঁদের সঙ্গেই আছেন। মুকুল নিজে স্পষ্ট করে কিছু না-বললেও ‘নভেম্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস’ বলে জল্পনা বাড়িয়েছিলেন। মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু অবশ্য কিছু দিন আগে প্রকাশ্য সভাতেই বলেন, তাঁর বাবা যা হয়েছেন তার সবটাই মমতার জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘যারা ভাবছেন তৃণমূল থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুকুল রায় আলাদা দল গড়বেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।’’

আজকের ঘটনার পরে মুকুলের দলত্যাগ বা নতুন দল গঠন, সব সম্ভাবনাই বেশ খানিকটা ফিকে
হয়ে গেল বলে রাজনীতিকদের অভিমত। আর তৃণমূলের অন্দরমহল বলছে, এক দিকে সনিয়া অন্য দিকে মুকুল— দু’জনকে কাছে টেনে এ বারের দিল্লি সফরে ঘরে-বাইরে বাজিমাত করলেন মমতা।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy