মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘লজ্জা করে না, দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারেন না!’’ আর বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বললেন, ‘‘আপনি পাকিস্তানের সুরে কথা বলছেন!’’
কথা ছিল সন্ত্রাসবাদীদের শিক্ষা দেওয়ায় ভারতীয় সেনাকে ‘সম্মান’ জানানো হবে রাজ্য বিধানসভায়। কিন্তু মঙ্গলবারের সেই আলোচনায় এ ভাবেই পরস্পরকেই ‘শিক্ষা’ দিল রাজ্যের শাসক ও প্রধান বিরোধী দল! সেনা-সম্মাননায় আনা প্রস্তাব রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনকে ভোটের তরজা- মঞ্চ করে রাখল প্রায় তিন ঘণ্টা। একেবারে শেষ পর্বে চেনা ঢঙেই সেই পারস্পরিক দোষারোপ পৌঁছল ব্যক্তিগত স্তরেও। দিনের শেষে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর বিরুদ্ধে শাসক পক্ষের তরফে আনা হল স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ। এই নিয়ে অষ্টম বার।
গোটা দেশের মতো রাজ্যেও ‘অপারেশন সিঁদুর’ বেশ কিছু দিন আগেই ঢুকে পড়েছে রাজনীতির বৃত্তে। তারই মাত্রা চড়িয়ে এ দিনের আলোচনায় কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ব্যর্থ’ চিহ্নিত করে সরকার পক্ষের প্রধান মমতা বলেন, ‘‘দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে (কেন্দ্রীয় সরকার) পুরো ‘ফেল’। সব ‘ফেল’ করেছে। এজেন্সিগুলি ‘ফেল’ করেছে।’’ সেই সূত্রেই পহেলগামের ঘটনা ও ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকে পুরোদস্তুর রাজনীতির বৃত্তে নিয়ে এসে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা বিদায় নিন। সরকারের পদত্যাগ করা উচিত!’’ প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে মমতার অভিযোগ, ‘‘যেখানে হামলা হয়েছে, সেখানে না গিয়ে বাজার করে বেড়াচ্ছেন!’’
গত সপ্তাহে কলকাতায় এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিজেপির কর্মিসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘যাঁকে দাঁড়াতে দেখলেই (বিধানসভায়) দিদি ভয়ে কেঁপে ওঠেন!’’ বিধানসভায় এ দিন সেই শুভেন্দুকে আগের চেয়ে অনেক কড়া সুরে আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেছেন, ‘‘অপদার্থ বিজেপি! দেশের লজ্জা! আর আপনি এক জন বিরোধী দলনেতা? লজ্জা! বাজে কথা বলবেন না। সামান্য ভদ্রতা জানেন না! অসত্য কথা বলেন। কী ভাবে গোল করতে হয়, জানেন না।’’ আর এক বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘আপনি ফ্যাশন বোঝেন। তা নিয়ে বলবেন, শুনব। রাজনীতি বোঝেন না, ওটা শুনব না! আপনার কীর্তিকলাপ জানা আছে!’’
স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনা এ দিনের প্রস্তাব সমর্থন করেও আক্রমণাত্মক ছিলেন বিরোধী দলনেতা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এলোপাথাড়ি গুলি করা হয়েছে। না, এলোপাথাড়ি নয়। বেছে বেছে খুন করা হয়েছে।’’ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পরে ১৯৮৪ সালে শিখ নিধনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এটা ‘টার্গেট কিলিং’।’’ সেই সঙ্গেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ শব্দ দু’টি প্রস্তাবে যোগ করার দাবি তুলে শুভেন্দু বলেন, ‘‘সিঁদুর নামে এত আপত্তি কেন! যাঁদের বাপ- ঠাকুরদা চিনে থাকেন, সেই কমিউনিস্টরা, মাকুরা সিঁদুর পরেন না।’’ এর পরেই ‘সিঁদুর’ নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি করেন বিরোধী দলনেতা।
প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা যে উত্তপ্ত হবে, সে আঁচ ছিল গোড়া থেকেই। শুরুতে রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু পহেলগামে হামলায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ৩৭০ ধারা বিলোপের পরে জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ হবে। তা তো হয়নি। গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা বলা হচ্ছে। আশা করি, এই প্রশ্নে আমরা সদুত্তর পাব।’’ বিজেপির আনন্দ বর্মণ বলেন, ‘‘আমাদের এখানে কিছু মিনি পাকিস্তান আছে! তারা ঠিক না হলে ২০২৬ সালে ‘অপারেশন বাংলা’ হবে!’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক রাজ্য সফরের প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলের মোশারফ হোসেন বলেন, ‘‘সেনাকে নিয়ে রাজনীতি করছেন। উত্তরবঙ্গে আসছেন। সেখানে আপনাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না!’’ আইএসএফের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকীর বক্তব্য, ‘‘কী করে এত ভিতরে জঙ্গিরা চলে এল, কেন গুলিবিদ্ধদের উদ্ধারে এত দেরি হল?’’ সেই সঙ্গেই রাজ্যের শাসককে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের একটা মিছিল করতে দেওয়া হল না, কেন?’’
সেনাকে সম্মান জানাতে গিয়ে বারবারই দু’পক্ষের বাদানুবাদে হট্টগোল হয়েছে এ দিন। বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রার অভিযোগে তা আরও বেড়ে যায়। অগ্নিমিত্রা বলেন, ‘‘সিঁদুর আমাদের অহঙ্কার অথচ প্রস্তাবে সেই শব্দটিই নেই! এটা কি কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে বার্তা দিতেই করা হয়েছে?’’ তার পরেই মালদহ ও মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক হিংসা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনকে খোঁচা দেন তিনি।
শেষ বক্তা মুখ্যমন্ত্রী তোপ দাগেন কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেই। মমতার প্রশ্ন, ‘‘কেন পহেলগামে এক জনও পুলিশ ছিল না? জঙ্গিদের এক জনকেও ধরা হল না কেন?’’ বিদেশে সংসদীয় প্রতিনিধি দলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছিলেন মমতা। আর এ দিন বিজেপির উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে কাজ আপনাদের করার কথা ছিল, তা বিরোধীরা করেছে।’’ কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার প্রমাণ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তান যে সাহায্য পেয়েছে, তার উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘এ বার আমাদের পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখল করার সুযোগ ছিল।’’
মুখ্যমন্ত্রী পাকিস্তানের হয়ে কথা বলছেন, এই অভিযোগে বিধানসভার বাইরে পরে সরব হয়েছেন শুভেন্দু। নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যায় তাঁর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তান কী ভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের কমিটিতে রাশিয়ার সঙ্গে সহ-সভাপতিত্ব পেয়েছে, কী ভাবে আইএমএফ, এডিবি-র ঋণ পেয়েছে? তাই বলেছি দেশের শত্রু পাকিস্তানের হয়ে ব্যাটিং করছেন। এই সবের সঙ্গে ভারতীয় সেনার সাফল্যকে সম্মান জানানো বা পহেলগামের হিন্দু চিহ্নিত করে খুন করার কী সম্পর্ক?’’
পাকিস্তানের সুরে মমতা কথা বলছেন, এই মন্তব্যের জন্যই বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব জমা দিয়েছেন শাসক দলের চার মন্ত্রী-বিধায়ক। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিধি মোতাবেক সম্ভবত বুধবারই তিনি ‘রুলিং’ দেবেন। যদিও এই প্রসঙ্গে বিরোধী দলনেতার বক্তব্য, “ওঁরা প্রশ্ন করলে উত্তর দেব। আগে সাত বার এই সব করেছে, কী হয়েছে তাতে? এঁদের দম সব জানা আছে।” তাঁর সংযোজন, “বিধানসভার বাইরের কথা যদি ধরা হয়, তা হলে ফিরহাদ হাকিম, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, উদয়ন গুহেরা যে কথাগুলো বলেছেন, সেই বিষয়ে কী হবে?’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)