E-Paper

মুক্তির খোঁজে স্বপ্নের খামার

ভারত যদি হয় এক দেহ, কৃষি তার হৃৎপিণ্ড। জীবনদায়ী ফসলধারার প্রবাহ থেকে যায় অন্তরালে, জোগান আটকে না গেলে তা নজরে আসে না। খবরের বাইরে রয়ে যায়।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৫৫

জায়গাটা পিয়ালির কাছে। দেওয়াল-ঘেরা বিঘে ছয়েক জমি, ভিতরে সরু সরু ‘প্লট’। একটা জমিতে ফলছে পুদিনা, ব্রকোলি, আইসবার্গ লেটুস, লাল বাঁধাকপি, পাশেরটাতে হলুদ ফুলকপি, চেরি টমেটো, মটরশুঁটি, মেথিশাক। ডোরা-কাটা শতরঞ্চির মতো, এক রঙের পর আর এক রঙের ফসলের সারি, পৌষের রোদে ঝলমল করছে। ছোট ছোট সাদা প্রজাপতি, ভোমরার ভোঁ ভোঁ। কাদের ফসল? এক-একটা জমির ফালিতে কঞ্চির মাথায় খুদে নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে এক-এক জনের নাম। কেউ থাকেন বালিগঞ্জ, কেউ সল্ট লেক। একটা মরসুম, মানে মাস তিনেকের জন্য ভাড়া নিয়েছেন জমি। চার-পাঁচটা পছন্দের আনাজের নাম দিয়েছেন। দূষণহীন, প্রকৃতি-বান্ধব আনাজ নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে তাঁদের বাড়িতে। বাড়তি আকর্ষণ? “আমরা বলি, আপনারা নিজের হাতে বীজ লাগাতে আসুন। মাঝে মাঝে এসে জল দিন, কথা বলুন গাছেদের সঙ্গে। নিজের হাতে তুলে নিয়ে যান নিজের ফসল,” বললেন এই উদ্যোগের কর্ণধার সুহৃদ চন্দ্র। সারা বছর ফসলের পরিচর্যা অবশ্য করেন ‘কৃষকরত্ন’-প্রাপ্ত শুভেন্দুশেখর দাশ ও তাঁর প্রশিক্ষিত সহযোগীরা।

দিল্লির উপকণ্ঠে শহুরে গেরস্তের কৃষি জমি ভাড়ায় নেওয়ার ব্যবস্থা আরও আগে শুরু হয়েছিল। কলকাতায় এই উদ্যোগ শুরু হয় কোভিডের সময়ে। সে সময়ে অনেকে, বিশেষত প্রবীণরা, ঝুঁকেছিলেন ছাদ-ব্যালকনিতে বাগানের দিকে। সহায়তা খুঁজছিলেন। তাঁদের এক জন, চিকিৎসক সুজিত কর পুরকায়স্থ বলেন, “নিজের বাড়ির ছাদে এত রকম আনাজ হচ্ছে দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল। তাই সুহৃদের জমি নিয়ে চাষ শুরু করতে শামিল হলাম। মাঝেমাঝেই যাই।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রামে এক ফালি জমি কেবল টাটকা, নিরাপদ আনাজের জোগানদার নয়, মনের শুশ্রূষা। কাজের চাপ, বিনোদনের উপকরণ যত বাড়ছে, অবসাদ আর উৎকণ্ঠাও তত বাড়ছে। হাঁপ ছাড়ার অবকাশ দিতে বড় সড়কগুলোর গায়ে ধানের খেতে গজিয়ে উঠছে রিসর্ট, নেচার ক্যাম্প। পর্যটক সেখানে গাছগাছালি দেখেন, চলে আসেন। যাঁরা চাষে মুক্তি চান, তাঁদের জন্য এ বছর সুহৃদ শুরু করছেন খেতের ধারে ঘর তৈরির কাজ।

বোলপুরের দশ কিলোমিটার দূরে এমন একটি অতিথিশালার এক বছর পূর্ণ হল এ বছর। ২০১৪ সালে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি নিয়ে দেবল মজুমদার আর অপরাজিতা সেনগুপ্ত শুরু করেছিলেন পারিবারিক খামার। পরিবারের যা কিছু খাদ্য সব আসবে নিজেদের জমি থেকে, এই ছিল লক্ষ্য। দীর্ঘ সময় কোনও সহায়ক রাখেননি, সব কাজ নিজেরাই করেছেন। এখন নিজেদের চাহিদা পূরণ করেও বেঁচে যাচ্ছে ধান, ফল। তাই একটা ছোট দোকান করে রাখছেন নিজেদের উৎপন্ন চাল, জ্যাম, আচার, স্কোয়াশ। সেই সঙ্গে সুস্থায়ী কৃষির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন উৎসাহীদের। যাঁরা অনেকেই শহুরে জীবনের ফাঁস থেকে মুক্তি খুঁজছেন স্বপ্নের খামারে।

চাষি বললেই যে বিপন্ন, দুর্দশাগ্রস্ত মুখের ছবি ভেসে ওঠে মনে, এঁরা তা নন। সুহৃদ দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন আইটি-তে, ডিজ়াইনার হিসেবে। দেবল ছিলেন সফটওয়্যারে, অপরাজিতা ইংরেজি পড়াতেন। দীর্ঘ দিন আমেরিকা-নিবাসী ছিলেন এই দম্পতি। কেরিয়ারের মাঝামাঝি নতুন বাঁক নিয়েছে জীবন। এঁদের কাছে কৃষি কেবল জীবিকা নয়, জীবনশৈলী। নিজেদের উৎসাহে নানা প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সুস্থায়ী চাষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন ফসলের চাহিদা তৈরি, বিপণনের নতুন কৌশল খুঁজছেন তাঁরা। এ তাগিদ যতটা বাণিজ্যিক, ততটাই ব্যক্তিগত। ‘সন্তানের মুখে কী তুলে দিচ্ছি?’ এই প্রশ্ন তাড়া করেছে অনেককে। চাষি যা বাজারে জোগান দেন তা নিজেরা খান না। সুপারমার্কেটে সাজানো ফল-আনাজগুলো যত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে, তত অপচয় হয়েছে জল, জ্বালানি। এ সবের প্রত্যাখ্যান করতে হলে বদলাতে হবে জীবনচর্যাকেই। অপরাজিতা জানালেন, তাঁর ছাত্রছাত্রীরা কেউ শহর থেকে গ্রামে যাতায়াত করছেন, কেউ বা শহর ছেড়ে সপরিবার চলে আসছেন গ্রামে। আসছেন প্রবীণরাও। উদ্যানপালন বিভাগের এক আধিকারিক বললেন, “কোভিড দেখিয়েছে, মানুষ একা বাঁচতে পারে না। যাঁরা রিটায়ার করে চাষ শুরু করেছেন, তাঁরা মন ভাল রাখতে চান, সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চান।”

ভারত যদি হয় এক দেহ, কৃষি তার হৃৎপিণ্ড। জীবনদায়ী ফসলধারার প্রবাহ থেকে যায় অন্তরালে, জোগান আটকে না গেলে তা নজরে আসে না। খবরের বাইরে রয়ে যায়। তাই কেউ যদি প্রশ্ন করে, ‘কী হল এ বছর’ তখন মনের মধ্যে যুদ্ধ, দাঙ্গা, নির্বাচনী হিংসা, দুর্নীতির পর্দাফাঁস— নানা শিরোনামের লড়াই বেধে যায়। অথচ, এগুলো জনজীবনের কতটুকু? যা কিছু থেকে আমরা জীবনের অর্থ আহরণ করি, উদ্দীপনা পাই, সান্ত্বনা পাই, তার সন্ধান নিয়ত চলেছে ক্ষুদ্রতা-হিংস্রতার বৃত্তের বাইরে।

কী করে বাঁচা সার্থক হয়, তার কোনও কোনও প্রচেষ্টা ব্যক্তিগত ভাবে শুরু হলেও এক সময়ে সামাজিক ধারা হয়ে ওঠে। জীবনের কেন্দ্রে সুস্থায়ী, সর্বমঙ্গলা কৃষিকে স্থাপন করা তেমনই এক স্রোত হয়ে দেখা দিয়েছে। উচ্চশিক্ষিতের ‘লাইফস্টাইল চয়েস’ থেকে অভিজ্ঞ চাষির বিকল্প সন্ধান, সব মিলে প্রত্যয়-প্রত্যাশার এক স্রোত। ক্ষীণ, কিন্তু দৃশ্যমান— হতাশা-তিক্ততার বালুরাশি তাকে এখনও গ্রাস করতে পারেনি।

এই স্রোতের শক্তি সংখ্যায় গোনা যায় না, গুনতে হয় গল্পে। সিউড়ির তাহালা গ্রামের রফিকুল আলম দিল্লিতে ফ্যাশন ডিজ়াইনারের কাজ করতেন। নবজাতক সন্তান রেখে স্ত্রীর মৃত্যু হতে আর কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। মাতৃহীন সন্তান কোলে, বিষাদ কাটিয়ে আয়ের পথ খুঁজতে বেছে নিলেন কলা চাষ। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তাঁর তৈরি সিঙ্গাপুরী (জি-৯) কলা তিনটের ওজনই এক কিলোগ্রাম। এ বছর ফলিয়েছেন দক্ষিণ ভারতের লাল কলা (খোসা লাল, ভিতরটা হলুদ) আর চিনে কলা। মাত্র সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার গাছ দিব্যি ফলবতী হয়েছে। ইচ্ছে রয়েছে করবেন ‘আইস বানানা’— নীলচে রং, শাঁসে ভ্যানিলার সুগন্ধ। রাজনগরের কানমোড়ায় মান্নান খান ১৫ বিঘেতে ড্রাগন ফ্রুট চাষ করছেন, বিঘে প্রতি ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকছে। জল লাগে সামান্য। হাইব্রিড ধানের চেয়ে কম জল-সারে বেশি লাভ দিচ্ছে ভিন দেশ, ভিন রাজ্যের ফসল।

আজ যে কোনও দেশের সুখাদ্য তৈরির রেসিপির জন্য দরকারি আনাজ (কেল, ব্রকোলি, লেটুস, বেবি কর্ন), ফল (ড্রাগন ফ্রুট, কিউই) সুগন্ধি উদ্ভিদ (লেমনগ্রাস, ডিল) পাওয়া যায় বাড়ির কাছের বাজারে। কী করে সম্ভব হল এই বিপুল বৈচিত্র? “সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে হত না,” বললেন উদ্যানপালনের ওই আধিকারিক। আনাজ চাষিদের কোম্পানি (এফপিসি), অসরকারি সংস্থা, বিকল্প চাষে বিনিয়োগকারী উদ্যোগপতি, কত মানুষের সাধনার ফল আমাদের ভাতের পাতে।

একশো বছর আগে রক্তকরবী নাটকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, যক্ষপুরীতে নন্দিনী সোনার তালে দেখেছিল কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত— “দেখছ না, এখানে সবাই যেন কেমন রেগে আছে, কিম্বা সন্দেহ করছে, কিম্বা ভয় পাচ্ছে?” তার কথার পিছনে কেবলই ভেসে আসছে পাকা ফসলের সোনা ঘরে তুলতে পৌষের গান। কালের প্রকোপে গড়পড়তা কৃষিও হয়ে উঠেছে মাটির তলা থেকে সম্পদ নিষ্কাশনের যন্ত্র। তার প্রাবল্য, প্রাচুর্য দীর্ঘ দিন মুগ্ধ রেখেছে দেশকে। যত দিন না গুনগুনিয়ে উঠেছে আক্ষেপ, “তোর প্রাণের রস তো শুকিয়ে গেল ওরে।” কৃষির সঞ্জীবনী রূপটির সঙ্গে নিজের অন্তরের সন্ধান ফের শুরু হয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Farmers cultivation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy