কলেজ পরিচালন সমিতির মাথায় বসে আরাবুল ইসলামদের মতো নেতাদের ছড়ি ঘোরানো ঠেকাতে নয়া আইনের পথে হাঁটতে চাইছিল সরকার। সেই মতো বিল তৈরিও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তর আপত্তি ওঠায় খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শেষ মুহূর্তে সেই বিল আর বিধানসভায় পেশ করেননি শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সেটা ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। দেড় মাস পরে নতুন করে যে বিল তৈরি করা হয়েছে, তাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাসক দলের নেতাদের রমরমার পথ খোলা থাকছে বলেই নবান্ন সূত্রের খবর।
নয়া খসড়া বিল আপাতত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাঁর সবুজ সঙ্কেত মিললে আজ, মঙ্গলবারেই তা পৌঁছে যাবে রাজভবনে। রাজ্যপালের ছাড়পত্র পাওয়া গেলে চলতি সপ্তাহেই (সম্ভবত ৯ ফেব্রুয়ারি) শিক্ষা প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিলটি ফের বিধানসভায় পেশ করবেন শিক্ষামন্ত্রী।
এ রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। বাম আমলে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ না-হলে কলেজ পরিচালন সমিতিতে ঠাঁই মিলত না বলেই অভিযোগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলিমুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এই পরিকল্পনা সিপিএমের অধুনা প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের মস্তিষ্কপ্রসূত। যা শিক্ষার ‘অনিলায়ন’ নামে খ্যাত হয়েছিল।
বিরোধী আসনে থাকাকালীন এই ‘অনিলায়ন’ নিয়ে নিত্য অভিযোগ করতেন তৃণমূলের নেতারা। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তাঁরাও অন্য পথে হাঁটেননি। এমনকী সৌগত রায়, সুগত বসুর মতো দলের শিক্ষাবিদ নেতারা প্রশ্ন তোলা সত্ত্বেও। শেষ পর্যন্ত ওই প্রবণতায় রাশ টানতে গত বছরের শেষ দিকে নতুন আইন তৈরিতে উদ্যোগী হয় সরকার। তৈরি হয় ‘দ্য ওয়েস্টবেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ (প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ) বিল, ২০১৬’। বাম জমানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির মাথায় ‘শিক্ষানুরাগী’কে বসানোর যে ছাড়পত্র ছিল, তা বাতিল করে শুধু শিক্ষাবিদকেই বসানোর কথা বলা হয় সেই বিলে।
যদিও সেই বদল নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কারণ, বিলে বলা হয়েছিল, কোন শিক্ষাবিদ পরিচালন সমিতির সভাপতি হবেন তা সরকারই ঠিক করে দেবে। বিরোধীরা এ নিয়ে আপত্তি তোলেন। আপত্তি ওঠে শাসক দলের অন্দরেও। তার কারণ অবশ্য ভিন্ন। তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানান, এই বদল হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলের আর কোনও প্রভাবই থাকবে না। যার জের গিয়ে পড়বে স্থানীয় রাজনীতি এমনকী ভোটের বাক্সেও।
প্রস্তাবিত বিলের আরও বেশ কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি ওঠে। এই অবস্থায় বিলটি পেশ করতে নিষেধ করেন মুখ্যমন্ত্রী। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়ে দেন, বিল স্থগিত রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘বিরোধীদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেই সরকার আপাতত বিলটি ফিরিয়ে নিচ্ছে।’’
কিন্তু বছর ঘুরে নতুন করে যে বিল তৈরি হয়েছে, তাতে কলেজের পরিচালন সমিতির মাথায় ‘শিক্ষানুরাগী’রাই থাকবেন— নবান্ন সূত্রে তেমনই খবর। ফলে শিক্ষিকার দিকে জগ ছুড়ে নাম কেনা আরাবুলের মতো নেতার কলেজে নিয়ন্ত্রকের পদে ফিরতে আর বাধা থাকছে না। অথচ বিলের আগের খসড়ায় সরকার মনোনীত শিক্ষাবিদ রাখা নিয়ে বিরোধীরা যখন প্রশ্ন তুলেছিল, তখন পার্থবাবু বলেছিলেন, ‘‘তা হলে তো পুরনো ব্যবস্থাই রেখে দিতে হয়। তা হলে তো আরাবুলরাই ভাল!’’ সোমবার এ নিয়ে প্রশ্নে অবশ্য তাঁর জবাব, ‘‘পুরনো বিলে যা ছিল, সেই পথেই হাঁটা হচ্ছে। সরকার সংস্কারের পথ থেকে সরছে না। শুধুমাত্র পদ্ধতি বদলাচ্ছে।’’
যদিও তৃণমূল এবং সরকারের একটি অংশের বক্তব্য, শিক্ষাবিদ শব্দটা থাকলে দলের অনেক সাংসদ-বিধায়কও আর পরিচালন কমিটিতে থাকতে পারতেন না! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলের নিয়ন্ত্রণই কার্যত থাকত না। অগত্যা পুনর্মুষিক ভব!
নয়া বিলে আর কী কী বদল হল? প্রস্তাবিত বিলে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির কর্তা থেকে শিক্ষক, অধ্যক্ষ এমনকী চতুর্থ শ্রেণির কর্মী— সকলকেই ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হলে তাঁদের ‘দুর্নীতি দমন শাখার’ অধীনে আনা যাবে। কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য, এটা হলে এঁরা সকলেই সরকারি কর্মী হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং কেউই ভোটে লড়তে পারবেন না। নতুন বিলে এই ধারাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, কোনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্য সরকারের কোনও নির্দেশ না মানলে বেতন কাটার ক্ষমতা শিক্ষা দফতরের হাতে নেওয়া হয়েছিল। সেই ধারাটিও বাদ যাচ্ছে নতুন বিলে।
তৃতীয়ত, বর্তমান আইনে কলেজ প্রশাসন চালাতে কেবল মাত্র অধ্যক্ষকেই ক্ষমতা দেওয়া আছে। নতুন বিলে অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে উপাধ্যক্ষ বা টিচার ইন চার্জের হাতেও সমান ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যে এখনও ১০০ কলেজে কোনও অধ্যক্ষ নেই। তাই রোজকার প্রশাসন চালাতে উপাধ্যক্ষের পদ তৈরি করা হল।
এ ছাড়াও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক কার্ড চালুর প্রস্তাব রাখা হয়েছিল পুরনো বিলে। নতুন বিলে বায়োমেট্রিক শব্দটির উল্লেখ না থাকলেও বলা হয়েছে, শিক্ষা দফতর মনে করলে কলেজের সময়ানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। পাশাপাশি, এখন বেশ কিছু কলেজের প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং অন্যান্য তহবিল অধ্যক্ষরা নিজেদের মতো করে ব্যাঙ্কে বা বিমা সংস্থায় রাখেন। সম্প্রতি দার্জিলিং-এ এই খাতের বিপুল টাকা তছরুপের অভিযোগও জমা পড়েছে। সরকার ঠিক করেছে, এখন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ড-সহ কলেজের সমস্ত তহবিল ট্রেজারিতেই রাখতে হবে। যা সিএজি অডিটের আওতায় থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy