সরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৮ করছে রাজ্য সরকার। নতুন সরকার শপথ নেওয়ার আগেই স্বাস্থ্য দফতরে এই সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গিয়েছে।
দফতর সূত্রের খবর, ফাইল স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে গিয়েছিল ভোটের আগেই। শুধু মুখ্যমন্ত্রীর সই বাকি ছিল। এখন সরকার দায়িত্ব নিলেই সরকারি শিক্ষক চিকিৎসকদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বেড়ে ৬৮ হবে। তা না-হলে নতুন মেডিক্যাল কলেজ সম্ভব নয়, পুরনো মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ছাত্রসংখ্যা বাড়ানো সম্ভব নয় ও সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল চালানোও অসম্ভব। শুধু সরকারি মেডিক্যাল কলেজ নয়, সরকারি হাসপাতালেও কর্মরত চিকিৎসকদের অবসরের বয়স ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সব নিয়ম চালু হলে স্বেচ্ছাবসরের রাস্তাও ফের খোলা হবে কি না, সে নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
শিক্ষক চিকিৎসকদের কত জন এই মেয়াদবৃদ্ধি চাইছেন? একটা অংশ অবশ্যই চাকরি আরও কয়েক বছর থেকে যাচ্ছে বলে খুশি। কিন্তু আরেকটা বড় অংশ শঙ্কিত, দিশেহারা। কারণ, তাঁরা আর চাকরি করতে চান না। তাঁদের মরিয়া দাবি, যাঁরা চাইছেন তাঁদের চাকরির মেয়াদ ৬৮ হোক। কিন্তু যাঁরা নারাজ তাঁরা যেন ৬৫-তেই অবসর নিতে পারেন বা ৬৮ হওয়ার আগে তাঁদের ইচ্ছামতো সময়ে স্বেচ্ছাবসর নিতে পারেন— এমন নিয়ম চালু হোক। ৬৮-তে অবসর যেন সবার উপরে বাধ্যতামূলক ভাবে চাপানো না হয়।
স্বাস্থ্য দফতর স্বেচ্ছাবসর বন্ধ করে দেওয়ায় নিকট অতীতে এমনিতেই অনেকে অবসর নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। অনেককে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। তাই চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, চাকরির মেয়াদ ৬৮ হলে স্বেচ্ছাবসরের নিয়মটুকু যেন ফিরিয়ে আনা হয়।
স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘একে তো মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া শিক্ষক-চিকিৎসকের সংখ্যা নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি রকমের নিয়ম করে রেখেছে। তার ওপরে নিট-এর নতুন নিয়মে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি আর নতুন করে ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী হবে না। আমাদের মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তার জন্য আরও শিক্ষক-চিকিৎসক দরকার। তাই অবসরের বয়স বাড়াতেই হচ্ছে।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, দফতরের বিশেষ সচিব ওঙ্কার সিংহ মিনা ফাইলটি তৈরি করেছেন। যদিও তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি মন্তব্য না করে এড়িয়ে গিয়েছেন।
সরকারের এই নতুন নীতিকে ঘিরে চিকিৎসক মহল দ্বিধাবিভক্ত। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসক বলেন, ‘‘সরকার অবসরের নিয়ম বদলাবে অথচ পদোন্নতির নিয়ম পাল্টাবে না, তা হতে পারে না। অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক পদ না বাড়িয়ে এটা করা ঠিকনয়। কারণ অধ্যাপকরা অবসর নেবেন না। তাঁরা না সরলে পদ খালি হবে না। তাঁদের অধস্তন ডাক্তারদের পক্ষে সেটা খুব যন্ত্রণার।’’
বামপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস’-এর বক্তব্য, অবসরের বয়সযদি প্রয়োজনে ৬৪ বা ৬৮ করতেই হয়, তবে সরকারের উচিত স্বেচ্ছাবসরের পথ খোলা রাখা। কারণ যদি ওই বয়সে কারও শারীরিক বা মানসিক সুস্থতা না থাকে, তা হলে চাকরি ছাড়ার জন্য যেন তাঁকে আদালতের দ্বারস্থ না হতে হয়। যেন তাঁদের পক্ষে স্বেচ্ছাবসর নেওয়াটা সহজ হয়।
তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’ অবশ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাই করেছিল। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, পিডিএ-র একটি গোষ্ঠী রাজ্যের বর্তমান স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তাকে আটকানোর জন্যই এই নিয়ম চালু হওয়ার বিরোধিতা করেছিল। অন্য দিকে, স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্তবাবুর লবি-ও তাঁর হয়ে দ্রুত এটি পাশ করানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে তাঁদের গোষ্ঠীরই।
অবসরের বয়স বাড়ানোয় প্রাক্তন স্বাস্থ্যকর্তাদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। যেমন, প্রাক্তন স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা চিত্তরঞ্জন মাইতির মতে, ‘‘হেলথ সার্ভিসে অবসরের বয়স ৬৪ এবং মেডিক্যাল এডুকেশনে ৬৮ করার প্রক্রিয়া শুরু করা ছাড়া আর পথ নেই। যদি এমসিআই নিয়ম শিথিল করে প্রত্যেক বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষকের সংখ্যা না কমায় তা হলে এটাই একমাত্র পথ।’’ ৬৮ পর্যন্ত কি মেডিক্যালের মতো বিষয়ে পড়ানো সম্ভব? তাঁর উত্তর, ‘‘অবশ্যই সম্ভব। আমি নিজেকে দিয়ে বুঝছি ৭০ বছর বয়সটাও এখন কিছুই না। তা ছাড়া এমসিআই নিজেই তো বয়সসীমা ৭০ করে রেখেছে। ভবিষ্যতে ৭৫ করার কথাও ভাবছে।’’
অন্য দিকে, রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যকর্তা শ্যামল বসু বলেন, ‘‘অবসরের বয়স বাড়ানোটা কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তা ছাড়া এমন কোনও নিয়ম তৈরি করাটাই ঠিক নয়। বিশেষ কোনও ক্ষেত্রে কোনও ডাক্তার যদি সেই সময়ে পাওয়া না যায়, তা হলে সেই ক্ষেত্রে হয়তো সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে বাড়তি সময় রেখে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কেউ বেঁচে আছেন বলেই তাঁকে ৬৮ পর্যন্ত কাজ করতে হবে, এমন নিয়ম হলে কোনও ভাবেই পঠনপাঠনের মান উন্নত হতে পারে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy