বক্তা: অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতার আসরে নিকোলা দোজেন এবং ক্লদিন ল্য ব্লাঁ। বৃহস্পতিবার বইমেলায়। ছবি: শৌভিক দে
বেদ থেকে এ কালের ইংরেজি ভাষার ভারতীয় লেখককুল— কেউ বাদ পড়ছেন না তালিকায়। ৩০টার বেশি ভারতীয় ভাষা, দলিত, আদিবাসী সাহিত্য কিংবা দেশান্তরীদের লেখালেখির ধারা-উপধারায় মজে আছেন তাঁরা দু’জনে। প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ভারত-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত নিকোলা দোজেন এবং ক্লদিন ল্য ব্লাঁ এখন এক মহাভারত সাগরের রত্ন হাতড়াচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার বইমেলার বচ্ছরকার পার্বণ, অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতার আসরে এই দুই ফরাসির সঙ্গে কলকাতার দেখা হয়ে গেল।
ফরাসি সরকারের উদ্যোগে ‘দেলি’ নামের একটি প্রকল্পে ভারতের আবহমান সাহিত্য বিষয়ক সুবৃহৎ কোষ গড়ে তুলছেন তাঁরা। জনা ৭০ পণ্ডিতের চেষ্টায় নিকোলা, ক্লদিনদের নেতৃত্বে ফরাসিদের জন্য ভারতীয় সাহিত্য অভিধানটির কাজ এগিয়ে চলেছে।
‘ভারতীয় সাহিত্য ও ফরাসি ভারততত্ত্ব’ বিষয়ক বক্তৃতায় দু’জনে মিলে তাঁদের সেই কাজের কথাই মূলত তুলে ধরলেন।
ভারত নামক প্রকাণ্ড সাড়ে বত্রিশ ভাজার প্রতি মুগ্ধ সম্ভ্রম ফুটে উঠছিল বক্তৃতার প্রতি পদে। সংস্কৃতজ্ঞ নিকোলা যেমন পুদুচেরির ফরাসি ইনস্টিটিউটে এ দেশের পুরাণ ও তার অভিঘাত নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন। ‘‘আমার কাজ ছিল পরশুরামকে নিয়ে। গুজরাতি, হিন্দি সব সাহিত্যে পরশুরাম কী ভাবে ছাপ ফেলেছেন, তা দেখার চেষ্টা করেছি।’’ সরবোনে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস ও পাঠ-ঘরানা বিষয়ক শিক্ষক নিকোলার চেতনায় এই পরশুরাম আবার ভারতীয়ত্বের চিরকালীন স্ববিরোধ বা ঠোকাঠুকিরও প্রতীক। তিনি বলছিলেন, ‘‘পরশুরাম বিষ্ণুর অবতার, আবার শিবেরও ভক্ত। ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষাত্রতেজে ভরপুর। হিন্দুত্বের সব টেনশন যেন মজুত ওঁর মধ্যে।’’
বাঙালির প্রিয় ‘পরশুরামে’র লেখা এখনও না-পড়লেও তাঁর নাম শুনেছেন নিকোলা। রাজশেখর বসু কেন ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে মজার লেখা লিখেছেন, তাই নিয়েও কথা বলছিলেন বক্তৃতার আগে। মজা বা তির্যক চোখে দেখার লেখা ‘রাগী’ পরশুরামের নামে লেখার মধ্যে এক ধরনের রসিকতা বা কূটাভাস আছে বুঝে খুব হাসলেন নিকোলা।
কন্নড় ভাষাবিদ পণ্ডিত, সরবোনের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক ক্লদিনও বললেন, ‘‘ফরাসিদের কাছে ভারতীয় সাহিত্যকে তুলে ধরার জন্য প্রেক্ষিত বুঝে তলিয়ে পড়ার দিকগুলো ধরিয়ে দেওয়া খুব জরুরি।’’ যেমন, ধর্ম বা মোক্ষ এই শব্দগুলো ভারতীয়রা যে ভাবে বোঝেন, পাশ্চাত্যের পাঠকেরা সচরাচর ধরতে পারেন না। তাই ফরাসি ভাষান্তরে ভারতীয় মননকে ফরাসিদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই হল তাঁদের চ্যালেঞ্জ। ফরাসি ভারততত্ত্ব এই ভিন্ন মেরুকে মেলানোর কাজটাই করে।
এক ঘণ্টায় দু’জনে মিলে উনিশ শতকের গোড়া থেকে ফ্রান্সের সারস্বত সমাজে ভারতচর্চা, গত শতকে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-বিভূতিভূষণ-শঙ্করের ফরাসিতে অনুবাদের আখ্যানও শোনালেন। তাঁদের অভিধানটির কাজ ২০১৯-এ শেষ হবে বলে আশাবাদী দুই ভারতপ্রেমিকই।
‘‘অভিধানে ভারতের মিথ, ইতিহাস, সাহিত্যের সম্পর্কগুলো খোলসা করা জরুরি। পদ্মাবত-বিতর্কের সব খবরই রাখছিলাম।’’ বইমেলা ছাড়ার আগে হাসতে হাসতে বলে গেলেন দু’জনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy